শুক্র (Venus) : শুক্র গ্রহ সূর্য থেকে দূরত্বের দিক দিয়ে সৌরজগতের দ্বিতীয়। এই পার্থিব গ্রহটিকে অনেক সময় পৃথিবীর ‘জমজ বোন গ্ৰহ’ বলে আখ্যায়িত করা হয়, কারণ পৃথিবী এবং শুক্রের মধ্যে গাঠনিক উপাদান এবং আচার আচরণে বড়ো রকমের মিল আছে। বাংলায় সকালের আকাশে একে ‘শুকতারা এবং সন্ধ্যার আকাশে একে ‘সন্ধ্যাতারা’ বলে ডাকা হয়ে থাকে। শক্রের কোনো উপগ্রহ শুক্রগ্রহে বিশাল পাহাড়, সমতলভূমি ও অনেক আগ্নেয়গিরি আছে। গ্রহটির অন্তঃসংযোগের সময় শুক্র অন্য যে-কোনো গ্রহের তুলনায় পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে আসে, তখন এ থেকে পৃথিবীর দূরত্ব হয় চাঁদ থেকে পৃথিবীর গড় দূরত্বের প্রায় ১০০ গুণ। ১৮০০ সালের পর থেকে শুক্র গ্রহ পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে পৌঁছেছিল ১৮৫০ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে। কখন তাদের মধ্যে দূরত্ব ছিল ০.২৬৪১৩৮৫৪ জ্যোতির্বিজ্ঞান একক = ৩৯,৫৪১,৮২৭ কিলোমিটার। ২১০১ সালের ডিসেম্বর ১৬ তারিখের পূর্ব পর্যন্ত এটিই হবে শুক্র থেকে পৃথিবীর সর্বনিম্ন দূরত্ব। উক্ত তারিখে গ্রহদ্বয়ের মধ্যবর্তী দূরত্ব দাঁড়াবে ০.২৬৪৩১৭৩৬ জ্যোতির্বিজ্ঞান একক = ৩৯,৫৪১,৫৭৮ কিলোমিটার। শুক্রকে বশে রাখার জন্য হিরা (রত্ন Daimond) বা হোয়াইট জারকন (উপরত্ন) রূপো (ধাতু) বা রামবাসক (মূল) বা ভুবনেশ্বরী (কবচ) ৬ মুখী/১৩ মুখী (রুদ্রাক্ষ) জ্যোতিষীরা নিদান দিয়ে থাকেন।
শনি (Saturn) : শনি সৌরজগতের ষষ্ঠতম গ্রহ। এটি সৌরজগতের দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্রহ। সূর্যের দিক থেকে এর অবস্থান ষষ্ঠ। হিন্দু পৌরাণিক দেবতা শনির নামানুসারে এই গ্রহের নামকরণ করা হয়েছে। রোমান দেবতা Saturn নামানুসারে ইংরেজি নামটি গ্রহণ করা হয়েছে। নিরক্ষীয় এলাকায় এর ব্যাস ১২০৮০ কিলোমিটার। সূর্য থেকে এর গড় দূরত্ব ১৪৭,২০,০০,০০০ কিলোমিটার। মেরু অঞ্চলের ব্যাস ১০৯০০০। এর ঘনত্ব জলের ০.৬৮ গুণ। সূর্যপ্রদক্ষিণকাল ২৯.৪৬ পার্থিব বৎসর। এটি নিজ অক্ষের উপর একবার আবর্তিত হতে সময় নেয় ১০ ঘণ্টা ৩৯ মিনিট ২৪ সেকেন্ড। এই গ্রহের কেন্দ্রে রয়েছে পাথুরে উপকরণ। মধ্য ও উপরিভাগের অধিকাংশই হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম দিয়ে তৈরি। এর সঙ্গে আছে জল, মিথেন এবং অ্যামোনিয়া। আর এই গ্রহকে ঘিরে রয়েছে বিস্তৃত বলয়। শনির উপরিভাগের ৭০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত মেঘরাশির উপর থেকে এই বলয়ের শুরু এবং তা প্রায় ৭৪০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। এই বলয়রাশির ভিতর বিভিন্ন পরিমাপের ফাঁকা জায়গা আছে। এই ফাঁকা স্থানের বিচারে এর বলয়গুলিকে কয়েকটি নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই ভাগগুলি হলো- ডি, সি, বি, এ, এফ, জি, ই। এর সবচেয়ে বড় ফাঁকা স্থানের নাম ক্যাসিনি বিভাজন, এর বিস্তৃতির পরিমাণ প্রায় ১২০,৬০০ কিলোমিটার। পক্ষান্তরে এ এবং বি বলয়ের মধ্যকার দূরত্ব প্রায় ৪৮০০ কিলোমিটার। বলয়টি এতটাই বিশাল যে, এর ভেতর একশ কোটি পৃথিবী ভরে রাখার মতো জায়গা আছে। বলয়টির মধ্যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বরফ, ধুলাবালি ইত্যাদি ধরা পড়ে। মূলত শনি গ্রহের রয়েছে ১৫০ টিরও বেশি উপগ্রহ, কিন্তু এর মধ্যে নাম দেওয়া হয়েছে মাত্র ৫৩ টি উপগ্রহের এবং আকার বিবেচনায় ১৮টি উপগ্রহকে মূল উপগ্রহ ধরা হয়। (১) প্যান, (২) ড্যাফনিস, (৩) অ্যাটলাস, (৪) প্রমিথিউস, (৫) প্যান্ডোরা বা প্যানডোরা, (৬) এপিমেথিউস, (৭) জ্যানাস, (৮) এগিয়ন, (৯) মাইমাস, (১০) মেথোনে, (১১) এন্থে, (১২) প্যালেন, (১৩) এনসেলাডাস, (১৪) টেথিস, (১৫) টেলেস্টো, (১৬) ক্যালিপ্সো, (১৭) ডাইয়োনে, (১৮) হেলেন, (১৯) পলিডিউসেস, (২০) রিয়া, (২১) টাইটান, (২২) হাইপেরিয়ন, (২৩) আইয়াপেটাস, (২৪) কিভিউক, (২৫) ইজিরাক, (২৬) ফোবে, (২৭) পালিয়াক, (২৮) স্কাথি, (২৯) অ্যালবাইয়োরিক্স, (৩০) এস/২০০৭ এস ২, (৩১) বেভিওন, (৩২) এরিয়াপাস, (৩৩) স্কল, (৩৪) সিয়ারনাক, (৩৫) তাকেক, (৩৬) এস/২০০৪ এস ১৩, (৩৭) গ্রেয়িপ, (৩৮) হাইরোক্কিন, (৩৯) জারুনসাক্সা, (৪০) তারভোস, (৪১) মানডিলফারি, (৪২) এস/২০০৬ এস ১, (৪৩) এস/২০০৪ এস ১৭, (৪৪) বার্গেলমির, (৪৫) নার্ভি, (৪৬) এস/২০০৪ এস ১২, (৪৭) ফারবাউটি, (৪৮) গ্রাই, (৪৯) এজির, (৫০) এস/২০০৭ এস ৩, (৫১) বেস্টলা, (৫২) এস/২০০৪ এস ৭, (৫৩) এস/২০০৬ এস ৩, (৫৪) ফেনরির, (৫৫) সুরতুর, (৫৬) কারি, (৫৭) ইমির, (৫৮) লোগে, (৫৯) ফোনজোট। সাধারণ মানুষ শনিগ্রহকে খুব ভয় করে। ভয় করার কারণ পুরাণে ভয়ংকর ভয়ংকর সব শনিকে ঘিরে কাহিনি। শনিকে বশে রাখার জন্য নীলা (রত্ন Blue Supphire) বা এমিথিস্ট (উপরত্ন) বা রূপো (ধাতু) বা শ্বেতবেড়েলা (মূল) বা দক্ষিণাকালী (কবচ) বা ৭ মুখী/১৫ মুখী (রুদ্রাক্ষ) জ্যোতিষীরা নিদান দিয়ে থাকেন।
রাহু (Rahu or Dragon’s head) ও কেতু (Ketu or Dragon’s tail) : জ্যোতিষীরা অবশ্য ‘রাহুর দশা’ ‘কেতুর দশা’ এসব বলে বটে! তাতেই মানুষ থরহরি কম্প! যদিও এখনও পর্যন্ত জ্যোতির্বিদরা রাহু ও কেতুর কোনো অস্তিত্বের কথা বলেননি। তবে এই রাহু-কেতু ব্যাপারটা কী? আমরা জানি যেমন পৃথিবীর কক্ষতলকে বলা হয় পৃথিবীর কক্ষতল, তেমনই চাঁদের কক্ষপথের তলকে বলা হয় চাঁদের কক্ষতল। এই দুই কক্ষতল পরস্পরের সঙ্গে ৫ ডিগ্রি কোণ করে আছে। যার কারণে চাঁদের কক্ষপথ পৃথিবীর কক্ষতলকে দুটি বিন্দুতে ছেদ করে। এই বিন্দু দুটিকে বলে রাহু ও কেতু, জ্যোতিষীরা একে গ্রহ হিসাবে কল্পনা করেন কেন কে জানে! হিন্দু পৌরাণিক কাহিনিতে রাহু জনৈক দানববিশেষ। বলা হয়েছে দানব বিচিত্তির ঔরসে ও সিংহিকার গর্ভে এঁর জন্ম হয়। উল্লেখ্য, সমুদ্রমন্থন শেষে উত্থিত অমৃত অসুরদের বঞ্চিত করে দেবতারা পান করেছিল। ইনি কৌশলে গোপনে অমৃতপান করতে থাকলে চন্দ্র ও সূর্য এঁকে চিনতে পেরে অন্যান্য দেবতাদের জানান। এই সময় বিষ্ণু সুদর্শন চক্রের রাহুর মাথা কেটে দেন। কিছুটা অমৃত পান করায় এই দানব ছিন্নমস্তক হয়ে অমরত্ব লাভ করেন। এঁর মস্তকভাগ ‘রাহু’ (Head) ও দেহভাগ ‘কেতু’ (Tail) নামে পরিচিত। সেই থেকে রাহু এবং চন্দ্র ও সূর্যের সঙ্গে চিরশত্রুতা শুরু হয়। এরপর থেকে সুযোগ পেলেই রাহু চন্দ্র ও সূর্যকে গ্রাস করার জন্য অগ্রসর হয়। কিছুটা গ্রাস করতে সক্ষম হলেও তার কর্তিত দেহ থেকে চাঁদ বা সূর্য বেরিয়ে আসে। রাহুর এই গ্রাসকালীন সময়ে গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয় বলে অনেকে বিশ্বাস করেন। অর্থাৎ রাহু যখন সূর্যকে গ্রাস করে তখন সূর্যগ্রহণ হয়। অন্যদিকে রাহু যখন চন্দ্রকে গ্রাস করে তখন চন্দ্রগ্রহণ হয়। জ্যোতিষীরা এই মতই বিশ্বাস করেন এবং বিশ্বাস করান। কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলেন সৌরজগতে সূর্যকে ঘিরে উপবৃত্তাকার পথে আবর্তিত হচ্ছে পৃথিবী, আবার পৃথিবীকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে চন্দ্র। চন্দ্র এবং পৃথিবীর এই আবর্তন চলার সময় কখনো-কখনো পৃথিবী, চন্দ্র ও সূর্যের মাঝখানে একই সরল রেখায় অবস্থান নেয়। এই সময় পৃথিবীর মানুষেরা চন্দ্রের আলো দেখতে পায় না। অর্থাৎ, পৃথিবীর ছায়ায় চাঁদ ঢাকা পড়ে যায়। পৃথিবী চাঁদের চেয়ে বড়ো হওয়ায় পৃথিবীর ছায়া চন্দ্রপৃষ্ঠকে পুরোপুরি ঢেকে ফেলে। এই কারণে চন্দ্রগ্রহণের সময় পৃথিবীর কোনো কোনো অংশে পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ দেখা যায়। যেখানে সূর্যগ্রহণ পৃথিবীর খুব অল্প জায়গা থেকেই দেখা যায়, সেখানে চন্দ্রগ্রহণ পৃথিবীর সর্বত্র থেকেই দেখা যায়। রাহু গোমেদ (রত্ন Gomed) বা গোয়া গোমেদ (উপরত্ন) বা রূপো (ধাতু) বা শ্বেতচন্দন (মূল) বা ছিন্নমস্তা (কবচ) বা ৮ মুখী/১৫ মুখী (রুদ্রাক্ষ) এবং কেতুকে বৈদুর্যমণি (Cats eye) বা সিসা/রূপো (ধাতু) বা অশ্বগন্ধা (মূল) বা ধূমাবতী (কবচ) বা ৯ মুখী/১৬ মুখী রুদ্রাক্ষ) বশে রাখার জন্য জ্যোতিষীরা নিদান দিয়ে থাকেন।