জাহাঙ্গীর তাকিয়ে দেখে খসরু, তখনও হাঁটু ভেঙে বসে রয়েছে, কাপুরুষোচিত আতঙ্কের একটা অভিব্যক্তি নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে। নিজের সন্তানের বিশ্বাসঘাতকতা, এত বিপুল সংখ্যক সৎ লোকের অনর্থক আত্মত্যাগের কথা চিন্তা করে, সে বহু কষ্টে খালি হাতে তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়া থেকে নিজেকে সংযত রাখে। পাঁচ মিনিটের মত কেবল প্রায় অতিক্রান্ত হয়েছে তারপরেই জাহাঙ্গীরের চারজন তোক উন্মত্তের মত ধ্বস্তাধ্বস্তি আর লাথি ছুঁড়তে থাকা বন্দিদের প্রথমজনকে–গাট্টাগোট্টা, রোমশ দেহের এক লোক যার পরনের কাপড়ের অধিকাংশই তাঁরা ছিঁড়ে ফেলেছে–শূন্যে অনেক উঁচুতে তুলে ধরে। তারা তারপরে তাদের পুরো শক্তি প্রয়োগ করে বর্শা আর কাঠের দণ্ডের সাহায্যে তড়িঘড়ি করে নির্মিত শূলগুলোর একটার উপরে তার দেহটা নিয়ে আসে। লোকটার মলদ্বারের কাছের নরম মাংসে যখন শক্ত তীক্ষ্ণ অংশটা প্রবিষ্ট হয়, তাঁর চিৎকারে–মানুষের চেয়ে পশুর সাথেই বেশি মিল–চারপাশের বাতাস বিদীর্ণ হয়। জাহাঙ্গীরের লোকেরা যখন হতভাগ্য বন্দির পা ধরে নিচের দিকে টানতে শুরু করে, সবেগে নির্গত রক্তে নিচের মাটি লাল করে, দণ্ডটা লোকটার কণ্ঠার হাড়ের কাছ দিয়ে দেহের বাইরে বের হয়ে আসে। তারপরে আরো বেশি সংখ্যক বিদ্রোহীদের যখন শূলবিদ্ধ করা হলে নাড়িভূঁড়ির বিদারণের এবং আতঙ্কিত মানুষজনের বিষ্ঠার, যারা মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজেদের নাড়িভূঁড়ির উপরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে, দুর্গন্ধ বাড়তে আরম্ভ করে। কিন্তু জাহাঙ্গীর, সে তখনও আপন ক্রোধে অধীর হয়ে রয়েছে এবং নিষ্ঠুর ন্যায়পরায়ণতা বিষয়ে একচিত্ত, এসব কিছুই লক্ষ্য করে না।
খসরুর এবার বিভীষিকা খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করার পালা যার জন্য তাঁর মাত্রাছাড়া উচ্চাকাঙ্খ দায়ী। জাহাঙ্গীর সামনের দিকে হেঁটে আসে এবং নিজের হাঁটু গেড়ে বসে থাকা সন্তানকে কাঁধ ধরে টেনে তুলে নিজের পায়ের উপরে তাকে জোর করে দাঁড় করিয়ে দেয়। দেখো, তোমার কারণে সবার কি দুর্গতি। কেবল তোমার কারণেই এই লোকগুলো কষ্ট পাচ্ছে। দণ্ডগুলোর মাঝ দিয়ে হেঁটে যাও… হাঁটতে শুরু কর,’ খসরুর মুখের একেবারে সামনে নিজের মুখ নিয়ে এসে, সে চিৎকার করে। তারপরে, নিজের সন্তানকে ছেড়ে দিয়ে, শূলের অভিমুখে সে তাকে একটা ধাক্কা দেয়। কিন্তু খসরু, তাঁর বাহুদ্বয় শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রাখে এবং দুচোখ প্রাণপনে বন্ধ করে রাখা, ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। জাহাঙ্গীর সাথে সাথে নিজের দেহরক্ষীদের কয়েকজনকে চিৎকার করে ডাকে। সবগুলো শূলের পাশ দিয়ে তাকে হেঁটে যেতে এবং পুনরায় ফিরে আসতে বাধ্য কর। সময় নিয়ে ধীরে সুস্থে কাজটা করবে। সবগুলো মৃতদেহের দিকে তাঁর তাকাবার বিষয়ে নিশ্চিত হবে…’
দু’জন প্রহরী সাথে সাথে দু’পাশ থেকে খসরুর হাত শক্ত করে ধরে এবং শূলের দিকে তাকে নিয়ে যায়। খসরুর মাথা প্রতি পদক্ষেপের সাথে নিচের দিকে ঝুঁকে আসে কিন্তু প্রতিবারই কয়েক পা হাঁটার পরে তাঁর প্রহরীরা শূলের উপর যন্ত্রণায় মোচড়াতে আর পা ছুঁড়তে থাকা এবং এটা করার কারণে নিজেকে আরো বেশি করে শূলবিদ্ধ করতে থাকা, তাঁর মৃত্যু পথযাত্রী সমর্থকদের কোনো একজনের ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে যায়, এবং সৈন্যদের একজন খসরুর মাথা চুল ধরে পেছনের দিকে টেনে এনে, তাকে দেখতে বাধ্য করে। কিন্তু স্পষ্টতই বোঝা যায় খসরুর যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে। জাহাঙ্গীর তাঁর সন্তানকে প্রহরীদের বাহুর মাঝে ঝুলে পড়তে এবং তারপরে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখে। সে অনুমান করে খসরু জ্ঞান হারিয়েছে। যথেষ্ট হয়েছে। আমার ছেলেকে এখানে ফিরিয়ে নিয়ে এসো, সেই সঙ্গে আজিজ কোকা আর হাসান জামালকে।
জাহাঙ্গীর কিছুক্ষণ পরে, তাঁর সামনে পুনরায় নতজানু হয়ে থাকা তিনজনকে খুটিয়ে দেখে। খসরুকে চাঙ্গা করতে প্রহরীদের একজন পানির মশকে রক্ষিত উপাদান তার উপরে নিক্ষেপ করায় তার লম্বা কালো চুল ভেজা। সে মড়ার মতো ধুসর আর থরথর করে কাঁপছে এবং দেখে মনে হয় যে কোনো মুহূর্তে বমি করবে। চারপাশের শূল থেকে ভেসে আসা যন্ত্রণার তীক্ষ্ণ আর্তনাদ, যেখানে অবশিষ্ট বিদ্রোহীদের তখনও শূলবিদ্ধ করা অব্যাহত রয়েছে, ছাপিয়ে তাঁর কথা সবার কাছে পৌঁছে দিতে জাহাঙ্গীর নিজের কণ্ঠস্বর একটু উঁচু করে বলে, তোমরা সবাই একজন প্রজা তাঁর জমিদারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে জঘন্য অপরাধের দোষে দোষী–সশস্ত্র বিদ্রোহ। তুমি
‘আমি কেবল একজন প্রজা না… আমি আপনার পুত্র…’ খসরু মিনতি জানায়, তাঁর একদা সুদর্শন তারুণ্যদীপ্ত মুখাবয়বে বিভীষিকার একটা অবিমিশ্র মুখোশ।
‘খামোশ! সন্তানের অধিকার দাবি করার পূর্বে নিজেকে প্রশ্ন করো তুমি কি সন্তানের যোগ্য আচরণ করেছে। তুমি কোনোভাবেই নরকের ঐ কীটগুলোর চেয়ে সহনশীল আচরণের উপযুক্ত নও যাদের নিদারুণ যন্ত্রণার জন্য আমি নই, বা তোমার পাশে যে দু’জন দাঁড়িয়ে রয়েছে তারা দায়ী, কেবল তুমি দায়ী। আজিজ কোকা, হাসান জামাল, আপনারা একসময়ে আমার প্রতি আনুগত্যের শপথ নিয়েছিলেন কিন্তু আপনাদের সেই অঙ্গীকার আপনারা ভঙ্গ করেছেন। তার দিকে অসহায়ভাবে তারা তাকিয়ে থাকে, সে কথা বলা বজায় রাখলে তাদের চোখে ভয় খেলা করতে থাকে, কোনো ধরনের করুণার প্রত্যাশা করবেন না, কারণ আমার কাছে প্রদর্শনের মত কোনো অজুহাত নেই। বিশ্বাসঘাতক আর অনবধান উচ্চাকাঙ্খী মানুষের পাশাপাশি পশুর অন্ধ মূঢ়তা আপনাদের ভিতরে কাজ করেছে। আপনাদের কুৎসিত পশু প্রবৃত্তি প্রতীকায়িত করতে আপনাদের লাহোর নিয়ে গিয়ে সেখানে বাজারে আপনাদের উলঙ্গ করা হবে এবং একটা ষাড় বা গাধার সদ্য ছাড়ানো চামড়ার ভিতরে ঢুকিয়ে সেলাই করা হবে। তারপরে গাধার পিঠে উল্টো করে বসিয়ে দিনের খরতাপে তোমাদের শহরের প্রধান সড়ক দিয়ে প্রদক্ষিণ করানো হবে আমার অনুগত প্রজারা যেন তোমাদের অপমানের সাক্ষী হতে পারে এবং অনুধাবন করতে পারে আমাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে তোমাদের অভিপ্রায় কতটা হাস্যকর ছিল।