জাহাঙ্গীর তার খয়েরী রঙের ঘোড়াটাকে যখন তাড়া দেয়, যা পশ্চাদ্ধাবনের প্রয়াসের কারণে আরো জোরে জোরে শ্বাস নেয়, সরু পাজর হাপরের মত উঠানামা করে, সে দেখে খসরুর লোকেরা আবারও একপাশে সরে যায় কিন্তু তারপরেই করকটে বৃক্ষাদির একটা ঝাড়ের কাছে থমকে দাঁড়িয়ে যায়। সে প্রথমে ভাবে প্রতিপক্ষ বোধহয় সেখানে অবস্থান নিয়ে লড়াই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কিন্তু তারপরে তাঁদের চারপাশে বিক্ষুব্ধ তরঙ্গের ন্যায় আন্দোলিত হতে থাকা ধুলোর মাঝে সে মাটিতে পরে থাকা পরিত্যক্ত অস্ত্রশস্ত্রের ঝিলিক দেখতে পায়। আজিজ কোকার নিষ্পাপ কিশোর ভাই আর আবদুর রহমানের অগ্রবর্তী বাহিনীকে যারা আক্রমণ করেছিল সেইসব সাহসী লোকদেরমত, আরো অনেককে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে তারা এখন নিজেদের মূল্যহীন জীবন বাঁচাতে আত্মসমর্পণ করতে চাইছে। জাহাঙ্গীর চোখে মুখে একটা ভয়াবহ অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলে নিজের খয়েরী ঘোড়াটা থেকে এর প্রাণশক্তির শেষ নির্যাসটুকু নিংড়ে নিতে পায়ের গোড়ালী দিয়ে নির্মমভাবে পরিশ্রান্ত জন্তুটার পাঁজরে গুতো দিয়ে ভাবে অপদার্থগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে সত্যিকারের পুরুষের মত মৃত্যুবরণ না করার সিদ্ধান্তের জন্য ভীষণ আফসোস করবে।
*
‘আমার সামনে তাঁদের হাজির করো।’
জাহাঙ্গীরের দেহে লড়াইয়ের স্বেদবারি তখনও উষ্ণতা হারায়নি এবং হৃৎপিণ্ড ক্রোধে উদ্বেল, সে বৃক্ষাদির ঝাড়ের নিচের ছায়া থেকে দেখে যে তাঁর সৈন্যরা খসরু, তাঁর প্রধান সেনাপতি, আজিজ কোকা এবং তাঁর অশ্বপালের আধিকারিক, হাসান জামালকে টেনে হেঁচড়ে সামনের দিকে নিয়ে আসে এবং তাঁর সামনে ধাক্কা দিয়ে তাঁদের হাঁটু মুড়ে বসিয়ে দেয়। সম্রাটের দিকে বাকি দু’জন যদিও চোখ তুলে তাকাবার সাহস দেখায় না, খসরু তার আব্বাজানের দিকে সানুনয়ে তাকিয়ে থাকে। তাদের পেছনে, খসরুর ত্রিশজনের মত লোক যারা তাঁর সাথে আত্মসমর্পণ করেছিল, তাঁদের পরনের কাপড় থেকে ছিঁড়ে নেয়া টুকরো কিংবা পর্যাণে ব্যবহৃত কম্বলের ফালি দিয়ে ইতিমধ্যে তাদের হাত পিছমোড়া করে বাঁধা হয়েছে। জাহাঙ্গীরের সৈন্যরা নির্মমভাবে ধাক্কা দিয়ে তাঁদের মাটিতে বসিয়ে দেয়। জাহাঙ্গীর বন্দিদের ভেতর সহসা দীর্ঘকায়, পেশল দেহের অধিকারী একজন লোককে চিনতে পারে, লোকটার দাড়ি মেহেদী দিয়ে লাল রঙ করা। তার মনে পড়ে যুদ্ধক্ষেত্রে লোকটাকে নিমেষের জন্য দেখেছিল, মুখে নির্মম হাসি ফুটিয়ে, নিজের ঘোড়া থেকে মাটিতে পড়ে যাওয়া অল্প বয়সী এক তরুণ যোদ্ধার উদর বর্শা দিয়ে এফোঁড়ওফোঁড় করে দেয়ার আগে, যে তাঁর সামনে আতঙ্কিত আর অসহায় অবস্থায় পড়ে ছিল, হাতের বর্শা দিয়ে বিদ্রুপাত্মক ভঙ্গিতে খোঁচা দিচ্ছে।
চরাচরগ্রাসী এমন একটা ক্রোধ জাহাঙ্গীরকে আপুত করে যে সে কিছুক্ষণের জন্য ঠিকমত কিছুই চিন্তা করতে পারে না। সে যখন নিজের উপর পুনরায় নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায় তখন তার মাথা জুড়ে কেবল একটাই বিষয় কীভাবে এমন নিশ্চেতন বিদ্রোহীকে যথাযুক্ত নির্মমতার সাথে শাস্তি দেবে। তারপরে সে যথাযথ শাস্তি খুঁজে পায়। মোগলরা পুরুষানুক্রমে জঘন্যতম অপরাধীদের শিশু হত্যাকারী, ধর্ষণের মত অন্যান্য অপরাধকারী–শূলে দিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে। প্রথম মোগল সম্রাট, বাবর, তাঁর প্রপিতামহ, বিদ্রোহী আর দস্যুদেরও এই শাস্তি দিতেন–এই লোকগুলোরও ঠিক একই রকম শাস্তি প্রাপ্য। আত্মসমর্পণের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তারা তাদের বিদ্রোহ চালিয়ে গিয়েছে, তাঁদের বর্শার ফলায় সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ সেইসব অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেদের বিদ্ধ করেছে। তাদের এবার বুঝতে দেয়া হোক শূলবিদ্ধ হবার অনুভূতি। একই আতঙ্ক আর যন্ত্রণা তাঁরাও সহ্য করুক। একমাত্র এভাবেই ন্যায়বিচার সম্ভব। সে বিষয়টা নিয়ে আর চিন্তাভাবনা না করে ক্রোধে কর্কশ হয়ে থাকা কণ্ঠে তার সৈন্যদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলে, এই গাছগুলো থেকে তোমাদের রণকুঠার আর তরবারি ব্যবহার করে শক্ত কাষ্ঠ দণ্ড প্রস্তুত কর। দণ্ডগুলো মাটিতে ভালোমত পুঁতে দাও। তোমাদের পক্ষে যতটা সম্ভব সেগুলোকে সূচালো করো কিংবা দণ্ডগুলোর অগ্রভাগে বর্শার ফলা সংযুক্ত করে নরকের কীট এই বিদ্রোহীদের সেইসব দণ্ডে বিদ্ধ কর। কাজটা করতে হবে এবং এখনই সেটা করতে হবে। আমার পুত্র আর তাদের, তার দুই প্রধান সহযোগীকে কেবল রেখে যাও। নিজেদের নিয়তি সম্পর্কে তারা অবহিত হবার পূর্বে নিজেদের লোকদের যন্ত্রণা তাদের দেখতে দেয়া হোক। তারা অন্যদের কেমন দুর্ভোগের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে সে বিষয়ে তারা সামান্য হলেও অনুধাবন করবে ভবিষ্যতের গর্ভে তাঁদের জন্য কি অপেক্ষা করছে তার পূর্বাভাষ।’
তার সৈন্যরা আদেশ পালনে দ্রুত ব্যস্ত হয়ে উঠে, রণকুঠার দিয়ে কেউ গাছ কাটতে আরম্ভ করে, অন্যরা তাৎক্ষণিকভাবে হাতের কাছে যা কিছু খুঁজে পায় এমনকি কেউ শিয়োস্ত্রাণ দিয়েই শূলের জন্য গর্ত তৈরি করতে মাটি খুড়তে আরম্ভ করলে বাকিরা তখন বন্দিদের শক্ত করে ধরে মাঠের উপর দিয়ে তাঁদের সবলে টেনে নিয়ে যায়, জাহাঙ্গীর তার বাহুর উপরে সুলেইমান বেগের হাত অনুভব করে। জাহাঙ্গীরের দুধ-ভাই কোনো কিছু বলার আগেই সে বলে, না, সুলেইমান বেগ, এটা কার্যকর করতেই হবে। তারা নিজেরাই শাস্তিটা বয়ে এনেছে। তাঁরা কোসো ধরনেরই করুণা প্রদর্শন করে নি। আমিও করবো না। আমি অবশ্যই একটা দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করবো।’