খসরু, আজিজ কোকা আর তাদের সহযোগী ষড়যন্ত্রকারীদের ক্ষমতার প্রতি অপরিণামদর্শী মোহের কারণে এতগুলো তাজা প্রাণের অকাল মৃত্যুতে তাঁদের প্রতি চরাচরগ্রাসী এটা ক্রোধ জাহাঙ্গীরকে আপুত করে তোলে। জাহাঙ্গীর তার খয়েরী ঘোড়াটার পাজরে গুঁতো দিয়ে ঢাল দিয়ে উপরের দিকে উঠতে শুরু করার আগে সুলেইমান বেগ আর নিজের দেহরক্ষীদের চিৎকার করে আদেশ দেয় তাকে অনুসরণ করতে। সে অচিরেই খণ্ডযুদ্ধের নিয়ামক স্থানে পৌঁছে, তার চারপাশে ইস্পাতের ফলা মৃত্যুর সিদ্ধান্ত করছে। জাহাঙ্গীরের তরবারি আলমগীর প্রতিপক্ষের এক অশ্বারোহীর গলায় একটা মোক্ষম ক্ষতচিহ্ন এঁকে দিতে সেখান থেকে ছিটকে উঠা রক্তে তাঁর মুখ ভিজে যেতে সে কয়েক মুহূর্ত চোখে কিছুই দেখতে পায় না। সে দ্রুত হাতের আস্তিনে চোখ মুছে নিয়ে, ইস্পাতের ফলার প্রতিদ্বন্দ্বীতা, চিৎকার আর আর্তনাদে মুখরিত এলোপাথাড়ি লড়াইয়ের দিকে ধেয়ে যায়।
ঘাম আর বারুদের ঝাঁঝালো গন্ধ তাঁর নাসারন্ধ্রে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেয় আর বাতাসে আধিপত্য বিস্তারকারী লাল ধুলো তাঁর চোখে ক্রমাগত গুল ফোঁটাতে থাকলে তার কাছে শত্রু মিত্রে প্রভেদকারী সীমান্ত প্রায় বিলীন হয়ে আসে। কিন্তু সে সুলেইমান বেগ আর দেহরক্ষীদের বেষ্টনীর মাঝে অবস্থান করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। আলমগীরের চূড়ান্ত একটা আঘাত যা খসরুর এক লোকের হাঁটুর উপর মোক্ষমভাবে ছোবল দিয়ে, পেশীত আর অস্থিসন্ধির গভীরে কেটে বসে যায় এবং আঘাতে প্রচণ্ডতায় আরো একবার জাহাঙ্গীরের হাত থেকে তরবারির হাতল প্রায় ছুটে যাবার দশা হয়, আর সেই সাথে জাহাঙ্গীর যুদ্ধক্ষেত্রের প্রথম ব্যুহ অতিক্রম করে। সে উপরের দিকে তাকিয়ে দেখে যে মাত্র চারশ গজ দূরে পর্বত শৃঙ্গের চূড়ায় খসরুর তাবুগুলোর অবস্থান। অবশ্য, সে যখন তাকিয়ে রয়েছে, দেখতে পায় বিশাল একদল অশ্বারোহী তাবুগুলো পরিত্যাগ করে শৈলচূড়ার অপর পাশে হারিয়ে যায়। অশ্বারোহীদের দলটা যখন চলে যাচ্ছে সে দেখে–বা তার মনে হয় সে দেখেছে–খসরু তাদের মাঝখানে অবস্থান করছে।
‘ওদের ধাওয়া কর। কাপুরুষগুলো পালিয়ে যাচ্ছে, সে নিজের খয়েরী ঘোড়ার পাঁজরে গুঁতো দিয়ে সুলেমান বেগ আর নিজের দেহরক্ষীদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলে। বিশাল জটা ইতিমধ্যে অবশ্য, কিছুক্ষণ আগে সংঘটিত যুদ্ধের ধকল সামলাতে নাকের পাটা প্রসারিত করে, ভীষণভাবে হাঁপাতে শুরু করেছে, এবং এই ঘোড়াটা যার স্থান নিয়েছে তাঁর আগের সেই সাদা ঘোড়ার মত স্বাস্থ্যবান আর তেজী এটা না। সে যখন পর্বত শীর্ষের চূড়ায় পৌঁছে, জাহাঙ্গীর শৈল শিখরের পাদদেশে মোতায়েন করা তাঁর যোদ্ধাদের একটা প্রতিরক্ষা ব্যুহের সাথে পলায়নকারী দলটাকে সংঘর্ষে লিপ্ত অবস্থায় দেখে। কিছুক্ষণের ভিতরেই মরিয়া দলটা প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করে বের হয়ে আসে, তাদের মাত্র একজন যোদ্ধা হত হয়েছে যার আরোহীবিহীন ঘোড়াটা লাগাম মাটিতে পরা অবস্থায়, মূল দলটার পেছন পেছন দৌড়াতে থাকে, সমভূমির উপর দিয়ে খুব কাছাকাছি অবস্থানে বিন্যস্ত হয়ে উত্তরের দিকে এগিয়ে যায়।
জাহাঙ্গীর খয়েরী ঘোড়াটার পাঁজরে পুনরায় গুতো দিয়ে ধাওয়া শুরু করলেও সে মনে মনে ঠিকই বুঝতে পারে পুরো প্রয়াসটাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। তার কুলাঙ্গার সন্তান নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। পলায়নের যে কোনো প্রয়াস বাধাগ্রস্থ করতে সে কেন আরো বেশি সংখ্যক অতিরিক্ত সৈন্য মোতায়েন করে নি? তাকে তারপরেই পরম স্বস্তিতে ভাসিয়ে মোগলদের সবুজ নিশান–খসরুর নিজের প্রতীকচিহ্ন হিসাবে দাবি করা বেগুনী নয়–উড়িয়ে সে দেখে একদল অশ্বারোহী পশ্চিম দিক থেকে অনিবার্য মুখোমুখি সংঘর্ষের অনিবার্য পথ বরাবর আবির্ভূত হয়। আবদুল রহমানও নিশ্চয়ই আগেই দলটার গতিবিধি দেখতে পেয়েছিল এবং তাঁদের পাঠিয়েছে। তারা খুব দ্রুত পলায়নপর দলটার সাথে নিজেদের দূরত্ব হ্রাস করতে থাকে। জাহাঙ্গীর তার দেহরক্ষী আর সুলেইমান বেগকে সাথে নিয়ে নিজের ক্লান্ত ঘোড়াটাকে পর্বত শিখরের শৈল শিরার দূরবর্তী প্রান্তের ঢালের দিকে ছোটার জন্য তাড়া দেয়। কিন্তু সে শৈল শিরার পাদদেশে পৌঁছাবার পূর্বেই, খসরুর লোকেরা তাদের পশ্চাদ্ধাবনকারীদের নিকট হতে চক্রাকারে ঘুরতে শুরু করে এবং তাঁদের পেছনে ধুলার একটা মেঘের সৃষ্টি করে, উত্তরপূর্ব দিকে আস্কন্দিত বেগে ছুটতে থাকে। জাহাঙ্গীর তখন খসরুর চার বা পাঁচজন পশ্চাদ্রক্ষীকে ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে উদ্যত তরবারি মাথার উপরে আন্দোলিত করে আবদুর রহমানের বাহিনীর দিকে ছুটে যায় উদ্দেশ্য একটাই নিজেদের জীবনের বিনিময়ে পলায়নের জন্য তাদের সহযোদ্ধাদের কিছুটা সময় করে দেয়া।
সে কয়েক গজ দূরত্ব অতিক্রম করার পূবেই এই সাহসী লোকগুলোর একজন, হাত দুপাশে ছড়িয়ে, তাঁর কালোর ঘোড়র উপর থেকে মাটিতে আছড়ে পড়ে, ধাওয়াকারীদের দলে আবদুর রহমানের বিচক্ষণতার কারণে প্রেরিত অশ্বারোহী তীরন্দাজদের কোনো একজনের নিক্ষিপ্ত তীরের আঘাতে এবং জাহাঙ্গীর কেবল বুঝতে পারে রেকাবের উপরে দাঁড়িয়ে তাঁরা তাঁদের আয়ুধ শূন্যে ছুড়ছে। খসরুর আরেক অনুগত যোদ্ধার বাহন কিছুক্ষণ পরেই আরোহীকে মাথার উপর দিয়ে ছিটকে দিয়ে, ভূপাতিত হয়। অন্য যোদ্ধারা তাঁদের আক্রমণের অভিপ্রায়ে নিজেদের ছুটে চলা অব্যাহত রাখে এবং আবদুর রহমানের অগ্রবর্তী অশ্বারোহীদের মাঝে আছড়ে পড়তে তারা নিজেদের সারির ভিতরে একটা শূন্যস্থানের সৃষ্টি করে তাদের মোকাবেলা করতে এবং ঘিরে ফেলে, তাঁদের অগ্রসর হবার গতি এর ফলে শ্লথ হয় কি হয় না। জাহাঙ্গীরের লোকেরা এক মিনিটেরও কম সময়ের ভিতরে ঘোড়ার গলার কাছে মাথা নিচু করে রেখে আবারও বল্পিত বেগে ছুটতে শুরু করে বিদ্রোহীদের বেশ কয়েকজনের মৃতদেহ আর ঘোড়া এলোমেলোভাবে তাঁদের পেছনে পড়ে থাকে। খুসরুর অনুগত যোদ্ধারা তাদের শত্রুদের কমপক্ষে দু’জনকে নিজেদের সাথে মৃত্যুর ছায়ায় টেনে নিয়েছে, কিন্তু তাঁদের সাহসিকতা খসরুকে বাঁচাতে পারবে না। আবদুর রহমানের বাহিনী পালাতে থাকা দলটার এখন প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে এবং আরো দু’জন পশ্চাদ্ক্ষীর, একজনের ঘোড়ার সাথে সংযুক্ত দণ্ডে খসরুর বেগুনী নিশান উড়ছে, ভবলীলার সমাপ্তি ঘটে, সম্ভবত অশ্বারোহী তীরন্দাজদের নৈপূণ্যের শিকার। নিশান-বাহকের পা তার ঘোড়ার রেকাবে আটকে যায় এবং সে লাল ধুলার উপর দিয়ে প্রায় একশ গজ হেঁচড়ে যাবার সময় বেগুনী নিশানটা তার পেছনে উড়তে থাকে। রেকাবের চামড়ার বাঁধন এরপরে ছিঁড়ে যেতে হতভাগ্য লোকটা আর তার বহন করা নিশানা দোমড়ানো মোচড়ানো অবস্থায় নিথর হয়ে পড়ে থাকে।