‘হ্যাঁ, আমার তো তাই মনে হয়… আপনার সাথে কি পানি আছে?
সুলেইমান বেগ তাঁর দিকে পানিপূর্ণ একটা চামড়ার তৈরি মশক এগিয়ে দেয়। জাহাঙ্গীর দু’হাতে মশকটা আঁকড়ে ধরে, সেটা উপুড় করে ধরে ব্যগ্রভাবে পানি পান করে।
‘আক্রমণের সময় এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠা আপনার মোটেই উচিত হয়নি। আপনি আমাকে আর আপনার দেহরক্ষীদের পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে গিয়েছিলেন। সম্রাট নিজেকে এভাবে অরক্ষিত করতে পারেন না।’
‘এটা আমার লড়াই। আমার নিজের ছেলে আমার শাসন অমান্য করে বিদ্রোহ করেছে এবং তাকে দমন করাটা আমার দায়িত্ব, জাহাঙ্গীর তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে, তারপরে জানতে চায়, ‘লড়াইয়ের কি খবর? অতিরিক্ত ঘোড়াটা আমাকে দাও। আরো একবার আক্রমণের নেতৃত্ব দিতে আমাকে অবশ্যই ফিরে যেতে হবে।’
‘আমি ঘোড়াটা আপনার জন্যই এনেছি–এবং আমি আপনার তরবারিও উদ্ধার করেছি, জাহাঙ্গীরের দিকে তরবারি আর ঘোড়ার লাগাম এগিয়ে দিয়ে, সুলেইমান বেগ বলে। কিন্তু আপনি কি নিশ্চিত যে আপনি সুস্থ রয়েছেন?
‘হ্যাঁ, জাহাঙ্গীর যতটা অনুভব করে কণ্ঠে তাঁর চেয়ে বেশি নিশ্চয়তা ফুটিয়ে বলে। অতঃপর সে তাঁর নতুন বাহন, খয়েরী রঙের উঁচু, ছিপছিপে ঘোড়ার পর্যাণে সুলেইমান বেগের সহায়তায় চার হাত পায়ের সাহায্যে বহু কষ্টে আরোহণ করে। সময় অতিবাহিত হবার সাথে সাথে তাঁর মাথা থেকে বিভ্রান্তির মেঘ অপসারিত হওয়ায় সে স্বস্তি বোধ করে, তারপরে সুলেমান বেগ আর নিজের কতিপয় দেহরক্ষী যারা ইতিমধ্যে তাঁর পাশে এসে অবস্থান গ্রহণ করেছে তাদের নিয়ে সে পুনরায় শৈলশিখরোপরি পথ দিয়ে উপরে উঠতে আরম্ভ করে যেখানে কয়েকটা তাবুর চারপাশে দারুণ লড়াই জমে উঠেছে। খসরুর অনুগত লোকেরা সেখানে দারুণ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। সে দেখে দু’পক্ষের যোদ্ধাদের বহনকারী ঘোড়াগুলো দুই পায়ের উপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায় তাদের আরোহীরা পরস্পরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হলে। খসরুর বেশ কয়েকজন অশ্বারোহী যোদ্ধা, সম্ভবত জাহাঙ্গীর আর সুলেইমান বেগকে চিনতে পেরে তাবুর চারপাশের লড়াই থেকে সরে আসে এবং তাঁদের আক্রমণ করতে আস্কন্দিত বেগে নিচের দিকে নামতে নামতে চিৎকার করে খসরু জিন্দাবাদ’, যুবরাজ খসরু দীর্ঘজীবি হোন!
একজন সরাসরি জাহাঙ্গীরের দিকে ধেয়ে আসে। হাত আর পা আন্দোলিত করে, উন্মত্তের ন্যায় ঘোড়া হাঁকিয়ে লোকটা ধেয়ে আসতে, জাহাঙ্গীর লক্ষ্য করে সে আর কেউ না আজিজ কোকার ছোট ভাই। তরুণ যোদ্ধা আরেকটু কাছাকাছি এসে জাহাঙ্গীরকে লক্ষ্য করে সে নিজের হাতের বাঁকানো তরবারি দিয়ে তাকেই লক্ষ্য গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে আঘাত হানতে সম্রাট মাথা নিচু করে আঘাতটা এড়িয়ে যান এবং তাঁর মাথার দুই ইঞ্চি উপর দিয়ে তরবারির ফলাটা বাতাসে শূন্যের ভিতর দিয়ে কক্ষপথে ঘুরে আসে। অশ্বারোহী আক্রমণকারী পাহাড়ের ঢাল দিয়ে নিচের দিকে আক্রমণের জন্য ধেয়ে আসার সময় গতিপ্রাবল্যের কারণে জাহাঙ্গীরকে অতিক্রম করে সামনের দিকে এগিয়ে গেলে, জাহাঙ্গীর পর্যাণের উপর কোমর থেকে দেহের উধ্বাংশ এক মোচড়ে ঘুরিয়ে নেয় এবং লোকটাকে বাধা দিতে তরবারির তীব্র বিপ্রতীপ আঘাত করতে তাঁর ঊর্ধ্ববাহুর হাড় মাংসের গভীরে তরবারির ফলা প্রবেশ করে, হাতটাই দেহ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। আক্রমণকারী লোকটা তার বাহনের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, তরুণ যোদ্ধা পাহাড়ের ঢাল দিয়ে দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে জাহাঙ্গীরের শিবিরের দিকে ধেয়ে নামতে থাকে যতক্ষণ না শিবিরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে উল্টানো মালবাহী শকটের পেছনে ইসমাইল আমলের মোতায়েন করা জাহাঙ্গীরের তবকিদের একজনের নিশানা ভেদী দুর্দান্ত একটা গুলি তাকে পর্যাণ থেকে ছিটকে দেয়।
জাহাঙ্গীর নিজের চারপাশে তাঁর চিরাচরিত তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে যে অন্য আক্রমণকারীদের হয় তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে কিংবা পাহাড়ের ঢাল দিয়ে উপরের দিকে পশ্চাদপসারণে বাধ্য করা হয়েছে। অনেকগুলো নিথর দেহ মাটিতে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ধুসর শ্মশ্রুমণ্ডিত, লাল আলখাল্লা পরিহিত দীর্ঘদেহী একটা লোক কাছেই পিঠের উপর ভর দিয়ে হাত পা ছড়িয়ে আকাশের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে পড়ে রয়েছে। তার উদরের ভেতর থেকে বর্শার একটা রক্তাক্ত ফলা বের হয়ে আছে। জাহাঙ্গীর লোকটাকে চিনতে পারে, তুহিন সিং, তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত দেহরক্ষীদের একজন–তাঁর আম্মাজানের মাতৃভূমি আম্বার থেকে আগত এক রাজপুত যোদ্ধা।লোকটা প্রায় সিকি শতাব্দি যাবত তাকে পাহারা দিয়েছে এবং এখন যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর জন্য প্রাণ দিয়েছে। কয়েক গজ দূরেই, লাল ধুলির মাঝে ক্ষীণদর্শন একটা অবয়ব তীব্র যন্ত্রণায় মোচড় খায় এবং তাঁর দেহ আক্ষিপ্ত হয়, তাঁর পায়ের গোড়ালী মাটিতে পদাঘাত করছে এবং দৃঢ়মুষ্ঠিতে নিজের উদর আঁকড়ে রয়েছে যেখান থেকে লালচে-নীল রঙের নাড়িভূড়ি বের হয়ে আসতে চেষ্টা করছে। লোকটা অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করে নিজের মাকে ডাকছে। ইমরানের শুশ্রুবিহীন বিকৃত মুখটা, আজিজ কোকার একেবারেই অল্পবয়সী ভাই, চিনতে পেরে জাহাঙ্গীর আঁতকে উঠে জোরে শ্বাস নেয়। তার বয়স কোনোমতেই তের বছরের বেশি হবে না এবং নিশ্চিতভাবেই আগামীকালের সূর্যোদয় দেখার জন্য সে বেঁচে থাকবে না।