জাহাঙ্গীর হাপড়ের মত শ্বাস নিতে নিতে শৈলশিখরের চূড়ার দিকে আস্কন্দিত বেগে ঘোড়া হাঁকায় এবং যে তাবুটাকে খসরুর নিয়ন্ত্রক তাবু হিসাবে সে করেছে, সেটা তখনও আধমাইলের মত দূরে, এমন সময় সহসাই তার বাহনের গতি মন্থর হতে আরম্ভ করে। সে পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখে প্রাণীটার বামপাশ ফুড়ে দুটো তীরের ফলা বাইরে বের হয়ে রয়েছে। ক্ষতস্থান থেকে গাঢ় লাল বর্ণের রক্ত ইতিমধ্যেই কুলকুল করে গড়াতে আরম্ভ করে প্রাণীটার সাদা চামড়ায় একটা দাগের জন্ম দিয়েছে। জাহাঙ্গীরের তখন নিজের সৌভাগ্য নিয়ে চিন্তা করার মত বিলাসিতার সময় নেই–তার বাম হাঁটু থেকে মাত্র এক কি দুই ইঞ্চি দূরে একটা তীর বিদ্ধ হয়েছে–তার আগেই ঘোড়াটা হুড়মুড় করে মাটিতে আছড়ে পড়তে আরম্ভ করে এবং বিশাল জন্তুটা মাটিতে ভূপাতিত হবার সময় এর নিচে চাপা পড়ার হাত থেকে বাঁচতে সে লাফিয়ে উঠে পর্যাণ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়। মাটিতে আছড়ে পড়ার সময় জাহাঙ্গীর তাঁর শিরোস্ত্রাণ আর তরবারি দুটোই খোয়ায় এবং পাথুরে মাটিতে বেকায়দায় অবতরণ করায় তার বুক থেকে সব বাতাস বের হয়ে যায়।
জাহাঙ্গীর মাটিতে বার বার গড়াতে গড়াতে নিজেকে কুকড়ে ফেলে একটা বলে পরিণত করতে চেষ্টা করে এবং সে তার দস্তানা আবৃত হাত দিয়ে পেছনের অশ্বারোহী যোদ্ধাদের ঘোড়ার খুরের আঘাত থেকে নিজের মাথা বাঁচাতে চেষ্টা করে যারা তাকে অনুসরণ করে আক্রমণে উদ্যত হয়েছে। ধাবমান ঘোড়ার পাল আর খণ্ডযুদ্ধের মূল এলাকা থেকে বেশ খানিকটা দূরে ঢাল বরাবর নিচের দিকে বেশ খানিকটা দূরত্ব অতিক্রম করার পরে ঢালের পাশে অবস্থিত পাথরের একটা স্তূপের সাথে ধাক্কা লেগে তার যন্ত্রণাদায়ক পতনের বেগ স্তব্ধ হয় কিন্তু তা সত্ত্বেও, দুদ্দাড় ভঙ্গিতে ধাবমান একটা খুর তার পিঠের ইস্পাতের বর্মে আঘাত করে। বিমূঢ় আর বিভ্রান্ত এবং কানের ভিতরে হাজারো ঘন্টা ধ্বনি আর চোখে অস্পষ্ট দৃষ্টি নিয়ে সে টলমল করে নিজের পায়ে দাঁড়াবার সময় সে কাছাকাছি অবস্থিত কালো পাথরের আরেকটা স্তূপের পেছন থেকে একজন লোককে উঠে দাঁড়াতে দেখে এবং একটা তরবারি বাতাসে আন্দোলিত করতে করতে তাঁর দিকে ধেয়ে আসে, স্পষ্টতই তাকে চিনতে পেরেছে এবং তাকে হত্যা কিংবা বন্দি করতে পারলে প্রাপ্য সম্মান আর সম্পদ অর্জনে একচিত্ত।
জাহাঙ্গীর সহজাত প্রবৃত্তির বশে তাঁর পরিকরের দিকে হাত বাড়ায় যেখানে রত্নখচিত ময়ানে তার খঞ্জরটা রয়েছে। সে পরম স্বস্তিতে আবিষ্কার করে সেটা এখনও সেখানেই রয়েছে এবং চাপদাড়ি আর কালো পাগড়ি পরিহিত রুক্ষ-দর্শন এবং স্থূলকায়–লোকটা তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগেই সে সময়মত খঞ্জরটা ময়ান থেকে বের করে। জাহাঙ্গীর লোকটার প্রথম আক্রমণের ঝাপটা কৌশলে এড়িয়ে যায় কিন্তু সেটা করতে গিয়ে তার পা পিছলে যায় এবং আবারও মাটিতে আছড়ে পড়ে। তাঁর হামলাকারী সুযোগ বুঝতে পেরে এবার দু’হাতে নিজের ভারি দুধারী তরবারি আঁকড়ে ধরে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে সেটা জাহাঙ্গীরের গলায় নামিয়ে আনতে চেষ্টা করে কিন্তু সে আঘাত করতে গিয়ে বড় তাড়াহুড়ো করায় জাহাঙ্গীরের বক্ষস্থল রক্ষাকারী বর্মে লেগে লোকটার আনাড়ি অভিঘাত পিছলে গেলে, লোকটা নিজেই নিজেকে ভারসাম্যহীন করে তোলে। জাহাঙ্গীর তার নাগরা পরিহিত পা দিয়ে প্রাণপনে লাথি হাঁকায় এবং তার প্রতিপক্ষের দু’পায়ের সংযোগস্থলে লাথিটা মোক্ষমভাবে আঘাত করলে সে নরম পেশীতন্তুর একটা তৃপ্তিকর স্পর্শ অনুভব করে। লোকটা তাঁর হাতের অস্ত্র ফেলে দিয়ে নিজের থেতলে যাওয়া অণ্ডকোষ খামচে ধরে, চরাচর স্তব্ধকারী ব্যাথায় হাঁটুর উপর কুকড়ে দু’ভাঁজ হয়ে আসে।
জাহাঙ্গীর নিজের সুবিধাজনক অবস্থার সুযোগ নিয়ে, তাঁর আক্রমণকারীর অরক্ষিত পায়ের গুলের শক্ত মাংসপেশীতে হাতের খঞ্জর দিয়ে দ্রুত দু’বার আঘাত করায়, লোকটা টলমল পায়ে একপাশে সরে গিয়ে মাটিতে পড়ে যায়। জাহাঙ্গীর ধুলি আচ্ছাদিত মাটির উপর দিয়ে হাচড়পাঁচড় করে এগিয়ে এসে নিজেকে লোকটার উপরে আছড়ে ফেলে এবং লোকটার কণ্ঠার হাড়ের ঠিক উপরের অরক্ষিত কণ্ঠনালীতে খঞ্জরের লম্বা ফলাটা আমূল গেঁথে দেয়। ফিনকি দিয়ে কিছুক্ষণ রক্ত উৎক্ষিপ্ত হয় আর তারপরে লোকটা নিথর ভঙ্গিতে মাটিতে পড়ে থাকে।
প্রাণহানির ঝুঁকি থেকে ভারমুক্ত হয়ে জাহাঙ্গীর যখন তার চারপাশে তাকায় তখনও সে চার হাতপায়ের উপর ভর দিয়ে রয়েছে এবং ঘন ঘন শ্বাস টানছে। সে তার ঘোড়র উপর থেকে মাটিতে আছড়ে পড়ার পরে অনেকটা সময় অতিক্রান্ত হয়েছে মনে হলেও আসলে পাঁচ মিনিটও অতিবাহিত হয়নি। মূল লড়াইটা বোধহয় শৈলচূড়ার বেশ খানিকটা উপরের দিকে সংঘটিত হচ্ছে। সে যদিও তখনও চোখে ঝাপসা দেখছে তার ভেতরেই সে বেশ কিছুটা দূরে অশ্বারোহী একটা অবয়বকে লক্ষ্য করে দ্রুত এগিয়ে আসছে এবং, ঝাপসা চোখে সে যতটা বুঝতে পারে, লোকটার সাথে আরেকটা অতিরিক্ত ঘোড়া রয়েছে। জাহাঙ্গীর টলমল করতে করতে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়ায় এবং নতুন কোনো আক্রমণের বিরুদ্ধে নিজেকে প্রস্তুত করতে চেষ্টা করে কিন্তু তারপরেই সে একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। জাহাঙ্গীর, আপনি কি সুস্থ আছেন?’ সুলেইমান বেগের কণ্ঠস্বর।