অবশ্য, স্পষ্টতই বোঝা যায় যে গোলন্দাজেরা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে এবং তড়িঘড়ি করে আগেই কামান থেকে গোলাবর্ষণ করা থেকে নিজেদের তারা বিরত রাখতে পারে না কারণ আবদুর রহমানের অগ্রবর্তী দলের অনেক সামনে তাদের নিক্ষিপ্ত গোলাগুলো এসে আছড়ে পড়ে ঝর্ণার মত উপরের দিকে ধুলো নিক্ষেপ করে। কিন্তু তারপরেই জাহাঙ্গীরকে আতঙ্কিত করে তুলে তাঁর আগুয়ান একটা রণহস্তী ইস্পাতের বর্ম দিয়ে আবৃত থাকা সত্ত্বেও হুড়মুড় করে মাটিতে আছড়ে পড়ে, বিশাল প্রাণীটা ভূপাতিত হবার সময় পিঠের হাওদাটাকে একপাশে ছিটকে ফেলে দেয়। আরো একটা হাতি মাটিতে পড়ে যায়। জাহাঙ্গীরের কাছে মনে হয় আক্রমণ বুঝি ব্যর্থ হতে চলেছে কিন্তু তারপরেও বিশাল প্রাণীগুলোর কানের পেছনে বসে থাকা মাহুতের দল প্রাণীগুলোকে সামনের দিকে এগিয়ে যাবার আদেশ দিতে, অবশিষ্ট হাতিগুলো তাদের ভূপাতিত সঙ্গীদের পাশ কাটিয়ে তাদের দেহের তুলনায় বিস্ময়কর দ্রুতগতিতে পাহাড়ের চূড়ার দিকে উঠে যাওয়া পথ দিয়ে অগ্রসর হতে শুরু করে। মাঝে মাঝে ধোয়ার কুণ্ডলী সৃষ্টি হতে বোঝা যায় যে হাতিগুলোর হাওদায় স্থাপিত ছোট কামান, গজনলগুলো থেকে গোলা বর্ষণ করা হচ্ছে। জাহাঙ্গীর একই সময়ে লক্ষ্য করে তার অশ্বারোহী যোদ্ধারা পর্বত শিখরোপরি পথ দিয়ে আক্রমণ শুরু করেছে, তারা লাল মাটির জোড়াতালি দিয়ে তৈরি করা অবরোধক লাফিয়ে অতিক্রম করার সময় সবুজ নিশানগুলো উঁচুতে তুলে ধরে এবং বর্শার ফলা সামনের দিকে বাড়িয়ে রাখে এবং খসরুর অশ্বারোহীদের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। উভয়পক্ষেই প্রচুর হতাহত হয় এবং যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দুলকি চালে আরোহীবিহীন ঘোড়াগুলো ছুটে যায় আবার কিছু ঘোড়া আক্রমণকারীদের অগ্রসর হবার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। জাহাঙ্গীরের দৃষ্টি ক্রমেই যুদ্ধক্ষেত্রের উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়া সাদা ধোয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় কিন্তু তার আগেই সে একদল অশ্বারোহীকে দেখতে পায়, মধ্যাহ্নের সূর্যকিরণে তাঁদের বক্ষস্থল আবৃতকারী বর্ম চিকচিক করছে, খসরুর তাবুর সামনে নিজেদের অবস্থান ত্যাগ করে দ্রুত আবদুর রহমানের আক্রমণের মুখে তাঁদের সহযোদ্ধাদের অবস্থান মজবুত করতে পশ্চিম দিকে এগিয়ে যায়। তার উপরেই যুদ্ধের সন্ধিক্ষণ নির্ভর করছে।
‘আমাদের এবার যাবার সময় হয়েছে, জাহাঙ্গীর ময়ান থেকে তাঁর পূর্বপুরুষের ব্যবহৃত ঈগলের মাথাযুক্ত হাতল বিশিষ্ট তরবারি আলমগীর টেনে বের করার মাঝে সুলেইমান বেগের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলে রেকাবের উপরে দাঁড়িয়ে নিজের তূর্যবাদকের উদ্দেশ্যে সেটা আন্দোলিত করে তাঁদের অগ্রসর হবার সংকেত ঘোষণা করতে বলে। জাহাঙ্গীরের সাদা ঘোড়া অচিরেই আস্কন্দিত বেগে ছুটতে শুরু করে, আবদুর রহমানকে সহায়তা দানে পূর্বে পরিকল্পিত মেকী যুদ্ধের ঢঙে ছোটার সময় জন্তুটার খুরের আঘাতে মাটিতে থেকে ধুলো উড়তে থাকে।
যুদ্ধের সমূহ সম্ভাবনায় জাহাঙ্গীরের নাড়ীর স্পন্দন দ্রুততর হতে থাকে। তার বয়স ছত্রিশ বছর হতে চলেছে কিন্তু তাঁর পূর্বপুরুষেরা এই বয়সে যত যুদ্ধের অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন সে তার তুলনায় অনেক কম যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছে, তাকে সামরিক নেতৃত্ব প্রদানে তাঁর আব্বাজানের অস্বীকৃতি এর জন্য আংশিক দায়ী এবং আংশিক দায়ী রাজ্য পরিচালনায় আকবরের সাফল্য যার ফলে মোগলদের খুব কমই যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হতে হয়েছে। সাম্রাজ্য যেহেতু তার সেই কারণে নেতৃত্বও তার এবং সে সমস্ত প্রতিদ্বন্দ্বীকে আজ গুঁড়িয়ে দেবে।
জাহাঙ্গীর তার সাদা ঘোড়া নিয়ে নিজের দেহরক্ষীদের মাঝ থেকে সামনে এগিয়ে যায় এবং তারপরে তাঁদের ইঙ্গিত করে ঘুরে গিয়ে পর্বতের শীর্ষে অবস্থিত শৈলশিরা বরাবর উঠে গিয়ে সামনের দিকে আক্রমণ করতে। তারা সবাই যখন আক্রমণ করতে ব্যস্ত, জাহাঙ্গীর পর্যাণের উপর মোড় দিয়ে পিছনে তাকিয়ে একজন অশ্বারোহী যোদ্ধা আর তাঁর খয়েরী রঙের ঘোড়াকে মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়তে দেখে, স্পষ্টতই বোঝা যায় খুব দ্রুত আর তীক্ষ্ণ বাঁক নিতে গিয়ে তাদের এই অবস্থা। মাটিতে পড়ে থাকা খয়েরী ঘোড়ার গায়ে আরেকটা ঘোড়া হোঁচট খায়, পাগুলো বাতাসে অক্ষম আক্রোশে আঘাত করে বিশাল জটা প্রাণপনে উঠার চেষ্টা করে। নিমেষের ভিতরে ভূপাতিত জন্তু আর তাঁদের আরোহীরা শৈলশিরার ক্রমশ খাড়া হয়ে উপরের দিকে উঠে যাওয়া পথ দিয়ে আক্রমণের বেগ ধীরে ধীরে জোরালো করতে আরম্ভ করলে তাদের পায়ের নিচে হারিয়ে যায়।
জাহাঙ্গীর তার হাতের তরবারি আলমগীর সামনে দিকে বাড়িয়ে ধরে, দূর্ঘটনা এড়াতে নিজের সাদা ঘোড়াটার গলার কাছে নিচু হয়ে ঝুঁকে এসে, পাহাড়ী ঢালটার গায়ে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য ছোটবড় পাথরের টুকরো এড়িয়ে যেতে মনোনিবেশ করে। সে তারপরেই পটকা ফাটার মত কড়কড় একটা শব্দ শুনতে পায় এবং একটা হিস শব্দ তুলে তার কানের পাশ দিয়ে গাদাবন্দুকের গোলা অতিক্রম করে। সে মাটির তৈরি প্রতিবন্ধকতার প্রথম সারির প্রায় কাছে চলে এসেছে। সে তার হাতে ধরা লাগাম আলগা করে দিয়ে ঘোড়র কানের কাছে ঝুঁকে এসে ফিসফিস করে। সামনের প্রতিবন্ধকতা লাফিয়ে অতিক্রম করতে সাহস দেয়, যা খুব বেশি হলে ফুট তিনেক লম্বা হবে। ঘোড়াটা যেন এই আদেশের অপেক্ষায় ছিল এবং সাথে সাথে লাফ দেয়। প্রতিবন্ধকতার উপর দিয়ে লাফিয়ে অতিক্রম করার সময় সেটার পিছনে লুকিয়ে থাকা শত্রুপক্ষের এক দীর্ঘদেহী তবকিকে লক্ষ্য করে জাহাঙ্গীর তরবারি চালায় বেচারা তখন মরীয়া হয়ে নিজের গাদাবন্দুকের লম্বা নল দিয়ে সীসার একটা নতুন গুলি ঠেসে ঢুকিয়ে দিয়ে সেটাকে পুনরায় গুলিবর্ষণের উপযোগী করার চেষ্টা করছে। লোকটা নিজের অভীষ্ট উদ্দেশ্য কখনই অর্জন করতে পারবে না, জাহাঙ্গীরের তরবারির প্রচণ্ড আঘাত লোকটার অরক্ষিত ঘাড়ের পেছনের অংশে কামড় বসায়, হাড়ের ভিতর দিয়ে একটা বীভৎস মড়মড় শব্দ করে এবং হতভাগ্য লোকটার কাঁধের উপর থেকে মাথাটা বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।