কতজন আত্মসমর্পণ করেছে?
‘হাজারখানের চেয়ে সামান্য কিছু কম হবে, বেশিরভাগই অপ্রতুল অস্ত্র আর পোষাক পরিহিত পদাতিক সৈন্য। অনেকেই সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ হয়েছে যারা খসরুর বাহিনী অগ্রসর হবার সময় উত্তেজনা আর লুটের মালের বখরার আশায় তাঁর সাথে যোগ দিয়েছিল। স্বপক্ষত্যাগী একজন বলেছে কীভাবে পালাবার চেষ্টা করার সময় ধৃত এক কিশোর সৈন্যকে খসরুর আদেশে শিবিরের জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয়েছে এবং বর্শার সুতীক্ষ্ণ অগ্রভাগ দিয়ে তাকে অগ্নিশিখায় ঠেসে রাখা হয়েছিল যতক্ষণ না তার চিৎকার স্তব্ধ হয়ে যায়। তার অঙ্গার হয়ে যাওয়া দেহটা এরপরে শিবিরের। ভেতরে প্রদর্শিত করা হয় অন্যদের তারমত পালাবার প্রয়াস গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখতে।
‘খসরুর সাথে এখন তাহলে কতজন লোক রয়েছে?
‘স্বপক্ষত্যাগী লোকটার বক্তব্য অনুযায়ী বারো হাজার। আমার মনে হয় সংখ্যাটা কমিয়ে বলা হয়েছে কিন্তু তাঁদের সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই পনের হাজারের বেশি হবে না।’
‘তাঁদের চেয়ে এখনও আমাদের তিন কি চার হাজার লোক বেশি রয়েছে। নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যুহের পেছনে গুঁড়ি মেরে প্রতিক্ষারত খসরুর সৈন্যদের চেয়ে আক্রমণকারী হিসাবে, অনেকবেশি অরক্ষিত থাকার কারণে আমাদের সৈন্যদের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য এই সংখ্যাটা যথেষ্ট।
জাহাঙ্গীর তার নিয়ন্ত্রক তাবুতে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হবার জন্য যখন তাঁর পরিচারক, তাঁর কর্চির জন্য অপেক্ষা করার সময় যখন পায়চারি করছে তার মনে একের পর এক প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে। সাফল্য নিশ্চিত করার জন্য সে কি সম্ভাব্য সবকিছু করেছে? একজন সেনাপতির জন্য আত্মবিশ্বাসে ঘাটতির মতই অতিরিক্ত-আত্মবিশ্বাসও বিশাল একটা হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। গতকাল অনেক গভীর রাত পর্যন্ত তিনি আর সুলেইমান বেগ যে পরিকল্পনা করেছেন সেটা কি সম্রাট হিসাবে তার প্রথম যুদ্ধে তাকে বিজয়ী করার জন্য যথেষ্ট বলে প্রমাণিত হবে? খসরুর বিশ্বাসঘাতকতার বিষয়ে তিনি কেন পূর্বেই প্রস্তুত ছিলেন না? আকবর যখন বেঁচে ছিলেন খসরু তাঁর দাদাজানের অনুগ্রহভাজন হবার চেষ্টা করেছিল, তার উত্তরাধিকারী হিসাবে মনোনীত হবার আশায়। আকবর যখন তাঁর পরিবর্তে জাহাঙ্গীরকে নির্বাচিত করেন, খসরু আপাত দৃষ্টিতে সেটা মেনে নিলেও সে আসলে নিজের সুযোগের জন্য অপেক্ষা করছিল। আগ্রা থেকে পাঁচ মাইল দূরে সিকানদারায় তাঁর দাদাজানের বিশাল সমাধিসৌধ নির্মাণের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণের বাহানা দেখিয়ে সে তার পুরো বাহিনী নিয়ে আগ্রা দূর্গ থেকে বের হয়ে যায়। সিকানদারা অভিমুখে না গিয়ে সে উত্তর দিকে সোজা দিল্লির উদ্দেশ্যে ঘোড়া হাঁকায়, পথে যেতে যেতে নতুন সৈন্য নিয়োগ করে সে তার বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি করতে থাকে।
জাহাঙ্গীর যখন চূড়ান্ত আদেশ দেয়ার জন্য তাঁর বয়োজ্যেষ্ঠ সেনাপতিদের একত্রিত করে সূর্য তখন আকাশের অনেক উঁচুতে উঠে গিয়েছে। আবদুর রহমান, আপনি, অশ্বারোহী বকি আর তীরন্দাজদের একটা বাহিনীর সাথে আমাদের রণহস্তির দলকে নেতৃত্ব দিয়ে পশ্চিম দিকে নিয়ে যাবেন শৈলচূড়া যেখানে ধীরে ধীরে সমভূমির সাথে এসে মিশেছে। আপনি সেখানে অবস্থান গ্রহণের পরে, শৈলচূড়ার হলরেখা বরাবর অগ্রসর হয়ে, খসরুকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করবেন যে এটাই হবে, যেমনটা প্রচলিত রণনীতিতে অনুসৃত হয়, আমাদের আক্রমণের প্রধান অভিমুখ।
‘কিন্তু এটা একটা ভাওতা। খসরুর সৈন্যদের যতবেশি সংখ্যায় সম্ভব নিবিষ্ট রাখার জন্য এটা একটা কৌশল। আমি আপনাকে শত্রুর সাথে পুরোপুরি নিবিষ্ট দেখার পরে, সুলেইমান বেগ আর আমি আমাদের আরেকদল অশ্বারোহী নিয়ে রওয়ানা দেব। প্রথমে, আপনাকে সহযোগিতা দেয়ার জন্য আমরা পশ্চিম দিকে যাবার ভান করবো কিন্তু তারপরেই আমরা ঘুরে গিয়ে সরাসরি আমাদের সামনে চূড়ার শীর্ষে অবস্থিত খসরুর তাবু অভিমুখে আক্রমণ করার জন্য পেয়ে যাব। ইসমাঈল আমল, এখানে অতিরিক্ত বাহিনীর নেতৃত্বে আপনি অবস্থান করবেন এবং লুটপাটের কোনো প্রয়াস থেকে আমাদের শিবিরকে রক্ষা করবেন। আপনারা সবাই কি নিজেদের ভূমিকা ঠিকমত বুঝতে পেরেছেন?
“জ্বী, সুলতান, সাথে সাথে প্রত্যুত্তর ভেসে আসে।
‘তাহলে আল্লাহতালা আমাদের সহায়। আমরা ন্যায়ের পক্ষে রয়েছি।
*
আধ ঘন্টা পরে, জাহাঙ্গীর পুরোদস্তুর যুদ্ধের সাজে সজ্জিত অবস্থায়, তাঁর ইস্পাতের শিরোস্ত্রাণের নিচে ঘামতে থাকে এবং ইস্পাতের কারুকাজ করা বক্ষ–এবং পৃষ্টরক্ষাকারী বর্ম তার দেহখাঁচা আবৃত করে রেখেছে। নিজের সাদা ঘোড়ায় উপবিষ্ট অবস্থায়, বিশাল প্রাণীটা খুর দিয়ে অস্থিরভাবে কেবলই মাটিতে আঘাত করছে যেন আসন্ন লড়াইয়ের আভাস আঁচ করতে পেরেছে, সে আবদুর রহমানের বাহিনীকে তূর্য ধ্বনি, ক্রমশ জোরালো হতে থাকা ঢোলের আওয়াজ আর মন্দ্র বাতাসে পতপত করে উড়তে থাকা সবুজ নিশানের মাঝে, সঙ্ঘবদ্ধভাবে অগ্রসর হতে দেখে। আগুয়ান বহরটা বিস্তৃত শৈলশিরার পাদদেশের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করতে খসরুর তোপচিরা নিকটবর্তী অবস্থান থেকে আক্রমণকারীদের লক্ষ্য করে নিজেদের অপেক্ষাকৃত বড় কামানগুলো থেকে গোলাবর্ষণ শুরু করলে বাতাসে সাদা ধোয়া ভাসতে দেখা যায়।