সম্রাট হিসাবে প্রথমবারের মত নিজের প্রজাদের সামনে নিজেকে উপস্থাপনের নিমিত্তে আগ্রা দূর্গের ইন্দ্রকোষ ঝরোকায় সে যখন পা রাখে, এবং নিচে যমুনার তীরে ভীড় করে থাকা মানুষের ভীড় থেকে সম্মতির সমর্থন ভেসে আসে, তাঁর আব্বাজান মৃত সেই বিষয়টাই তখন প্রত্যয়াতীত মনে হয়। আকবর সমৃদ্ধ আর জাক-জমকপূর্ণ একটা সাম্রাজ্য নির্মাণ করেছিলেন সমস্ত বিপদ আর প্রতিবন্ধকতাকে দূরে সরিয়ে রেখে। আকবর বেঁচে থাকার সময় জাহাঙ্গীরের যেমন প্রায়শই মনে হতো সে কখনও আকবরের ভালোবাসা পুরোপুরি অর্জন করতে পারে নি কিংবা তার প্রত্যাশা অনুযায়ী জীবন যাপন করতে পারে নি, আকবরের মৃত্যুর পরে তার মনে এখন সহসাই সন্দেহের মেঘ ঘনীভূত হয় যে এখন সেটা আদৌ তার পক্ষে অর্জন করা সম্ভব। কিন্তু সে চোখ বন্ধ করে এবং নিরবে একটা প্রতিজ্ঞা করে। আপনি আমাকে সম্পদ আর ক্ষমতা দান করেছেন। আপনার যোগ্য উত্তরসূরি হিসাবে আমি নিজেকে প্রমাণ করবো। আপনি আর আমার পূর্বপুরুষেরা যা নির্মাণ করেছেন আমি সেটা রক্ষা করবো এবং বর্ধিত করবো। নিজের কাছে নিজের এই প্রতিজ্ঞার ব্যাপারটা তাঁর আত্মবিশ্বাসকে শাণিত করে তুলে।
কিন্তু এই ঘটনার সপ্তাহখানেকের ভিতরেই প্রথম আঘাত আসে, কিন্তু কেএনা আগন্তুক নয় বরং তাঁর নিজের আঠারো বছরের ছেলেই সেই আঘাতটা হানে। বিশ্বাসঘাতকতা–এবং এর ফলে সৃষ্ট বাতাবরণ সবসময়েই একটা নোংরা ব্যাপার, কিন্তু নিজের সন্তানই যখন সেটার উদ্গাতা তখন এর চেয়ে জঘন্য আর কিছুই হতে পারে না। মোগলদের যখন একত্রিত থাকার কথা তখন পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই করে মোঘলরা অনেক সময়ে নিজেরাই নিজেদের প্রবল শত্রুতে পরিণত হয়েছে। এই একই বিন্যাসের পুনরাবৃত্তি সে কখনও, কিছুতেই অনুমতি দিতে পারে না এবং এখন তাঁর রাজত্বের সূচনা লগ্নে সে সবাইকে দেখিয়ে দিতে চায় যে পারিবারিক অবাধ্যতার বিষয়টা সে ভীষণ ঐকান্তিকতার সাথে গ্রহণ করেছে এবং কত দ্রুত আর পুরোপুরি সে এই বিদ্রোহীদের দমন করবে।
বিগত কয়েকটা সপ্তাহ তাঁর নিজের বাহিনী আর তাঁর পুত্রের বাহিনীর মাঝে দূরত্ব হ্রাস করার অভিপ্রায় ছাড়া আর কিছুই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। সে আর তার বাহিনী গতকাল সন্ধ্যাবেলা খসরুর নাগাল পায় এবং সে যেখানে শিবির স্থাপন করেছে সেই শৈলশিরাময় অংশটা ঘিরে ফেলে। আপন সন্তানের বিশ্বাসঘাতকতার বিষয়ে সে যতই চিন্তা করে ততই গা গুলিয়ে ওঠা ক্রোধের একটা ঢেউ তার উপরে এসে আছড়ে পড়ে এবং পায়ের গোড়ালী দিয়ে সে বালুকাময় মাটিতে সজোরে আঘাত করে। সে সহসা নিজের পাশে তার দুধ-ভাই সুলেমান বেগের উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে। ‘এতক্ষণ কোথায় ছিলে?’ সে জানতে চায়, অবদমিত আবেগের কারণে তাঁর কণ্ঠস্বর রুক্ষ শোনায়।
রাতেরবেলা খসরুর শিবিরের কাছাকাছি আমাদের গুপ্তদূতদের যারা গিয়েছিল তাদের কাছ থেকে সর্বশেষ অগ্রগতি সম্পর্কে শুনছিলাম।
‘তারা তাহলে, কি বললো? আমার ছেলে কি অনুধাবন করতে পেরেছে যে সে আমাদের নাগাল থেকে পালাতে পারবে না এবং তাকে অবশ্যই নিজের বিদ্রোহের পরিণতি ভোগ করতে হবে?
“জ্বী। সে যুদ্ধের জন্য নিজের বাহিনীকে প্রস্তুত করছে।’
‘সে আর তাঁর সেনাপতিরা কীভাবে নিজেদের সৈন্যদের বিন্যস্ত করছে?
‘শৈলচূড়ায় বেলেপাথরের তৈরি হিন্দুদের কয়েকটা স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে। তাঁরা এগুলোর চারপাশে নিজেদের মালবাহী শকটগুলোকে উল্টে দিয়েছে এবং নিজেদের তবকী আর তিরন্দাজদের সুরক্ষিত রাখতে এবং তাঁদের কামানগুলোকে আড়াল করতে মাটির অবরোধক নির্মাণ করছে।
তার মানে আক্রমণ করার পরিবর্তে তারা আক্রমণ প্রতিহত করার প্রস্তুতি নিচ্ছে?’
‘জ্বী। তাঁরা জানে এটাই তাদের সাফল্যের শ্রেষ্ঠ সুযোগ। খসরু কিংবা তাঁর প্রধান সেনাপতি আজিজ কোকা কেউই নির্বোধ নয়।’
‘আমার কর্তৃত্ব অগ্রাহ্য করা ছাড়া, জাহাঙ্গীর তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে।
‘আমি কি আমাদের বাহিনীকে আসন্ন আক্রমণের জন্য এখনই বিন্যস্ত হবার আদেশ দেব?
‘আমি সিদ্ধান্ত নেবার পূর্বে, শৈলচূড়ার উপরে পানি কিংবা ঝর্ণার কোনো উৎসের ব্যাপারে আমরা কি কিছু জানি?
‘গতকাল সন্ধ্যাবেলা আমাদের সাথে কেবল একজন পশুপালকের দেখা হয়েছিল আমি তাকে প্রশ্ন করেছিলাম। সে বলেছে নেই কিন্তু বেচারা এতটাই আতঙ্কিত ছিল যে আমি যা শুনতে চাই বলে তার কাছে মনে হয়েছিল সে হয়ত সেটাই তখন বলেছিল। অবশ্য, চূড়াটার সর্বত্রই লাল ধূলো আর পাথর মাঝে মাঝে কেবল কয়েকটা মৃতপ্রায় গাছ আর বিক্ষিপ্তভাবে জন্মানো ঘাস রয়েছে।
‘পশুপালক লোকটা তাহলে হয়তো ঠিকই বলেছে। সেক্ষেত্রে, তাঁদের সাথে যৎসামান্য যতটুকু পানি রয়েছে সেটা নিঃশেষ করার জন্য আমরা বরং এখনই তাঁদের আক্রমণ করা থেকে আরো কিছুক্ষণ বিরত থাকি তারা এখন যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেদের ভাগ্য নিয়ে চিন্তা করুক। খসরুর মতই, তাঁরা সবাই অল্পবয়সী আর যুদ্ধে অনভিজ্ঞ। এমনকি যুদ্ধের ভয়ঙ্কর বিভীষিকাও তাঁদের কল্পনাকে ছাপিয়ে যাবে।’
‘হয়ত, কিন্তু আমাদের দেয়া আত্মসমর্পণের প্রস্তাবে আমি যেমনটা আশা করেছিলাম তারা ঠিক সেভাবে সাড়া দেয়নি।
জাহাঙ্গীর চোখমুখ কুঁচকে কিছু একটা ভাবে। গত সন্ধ্যায় সে সুলেমান বেগের প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছিল খসরুর শিবির লক্ষ্য করে বার্তাবাহী তীর নিক্ষেপ করার ব্যাপারে যেখানে লেখা থাকবে যেকোনো নিম্নপদস্থ সেনাপতি কিংবা কোনো সৈন্য যারা সেই রাতে খসরুর শিবির ত্যাগ করে আত্মসমর্পণ করবে তাদের প্রাণ রক্ষা পাবে। দ্বিতীয় কোনো সুযোগ দেয়া হবে না। কেউ যেন মনে না করে যুদ্ধের পরে কারো প্রতি কোনো ধরনের করুণা প্রদর্শন করা হবে।’