সে মুখ থেকে ঘাম মুছে সতর্কতার সাথে দেয়ালের অপর পাশে নিজেকে নিচু করে, বাঁশ ঝাড়ের মাঝে তাঁর খুঁজে পাওয়া ফাঁকা স্থানে মাটি থেকে যখন দশ ফিট উপরে রয়েছে সে হাত ছেড়ে দেয়। সে উবু হয়ে বসে, হৃৎপিণ্ডের ধকধক শব্দের ভিতরে, শুনতে চেষ্টা করে। কোনো শব্দ নেই, সব চুপচাপ। এটা ভালো লক্ষণ। এখন নিশ্চিতভাবেই মধ্যরাত্রি অতিক্রান্ত হয়েছে কিন্তু এখনও তার পরিকল্পনামাফিক কাজ শুরু করার জন্য অনেক সময় বাকি আছে। সে সামান্য নড়েচড়ে নিজের অবস্থানকে একটু আরামদায়ক করে। সে টের পায় একটা ছোট জম্ভ–একটা ইঁদুর বা টিকটিকি হবে–তাঁর পায়ের উপর দিয়ে দৌড়ে যায় এবং মশার চির পরিচিত ভনভন শুনতে পায়। খানিকটা কুচকে, সে সামনের কাজটায় মনোসংযোগের চেষ্টা করে।
রাত যখন প্রায় একটার কাছাকাছি, বার্থোলোমিউ তখন ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে, প্রথমে বাঁশের ঝাড়ের এবং পরে একটা ছড়ান ডালপালাযুক্ত পাতাবহুল আমগাছের আড়াল ব্যবহার করে। চাঁদের আলোয়, সে দেখতে পায় প্রহরীর তরুণ মাথাটা তাঁর বুকের উপরে ঝুঁকে এসেছে এবং সে স্পষ্টতই নিজের তেপায়ার উপরে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তার পেছনে বাড়ির ভেতরের আঙিনা, দেয়ালের কুলঙ্গিতে রক্ষিত কয়েকটা ক্ষুদ্রাকতি মশালের আলোয় আধো আলোকিত, নিরব আর শান্ত। বার্থোলোমিউ বাগানের উপর দিয়ে দ্রুত বেগে দৌড়ে পানি নির্গত হতে থাকা ঝর্ণার পাশ দিয়ে বাড়ির দেয়ালের দিকে এগিয়ে গিয়ে, দরজার বাম পাশে ঝুল বারান্দার কারণে অন্ধকার হয়ে থাকা একটা জায়গা বেছে নেয়। সে দেয়ালের সাথে পিঠ সোজা করে রেখে এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করে সে নিজের শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে।
সে তারপরে গুটি গুটি পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করে। দরজার কাছে পৌঁছে সে দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকি দেয়। সে দ্বাররক্ষীর এতটাই কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে যে তার মৃদু নাক ডাকার শব্দ অব্দি সে শুনতে পায়। কিন্তু কোথাও আর কোনো শব্দ নেই। সে মাংসপেশী টানটান করে, দরজার ভিতর দিয়ে সে লাফ দিয়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে, তরুণ প্রহরীকে দু’হাতে আঁকড়ে ধরে তাকে তুলে বাগানে নিয়ে আসে এবং ডান হাতে শক্ত করে তাঁর মুখ চেপে রেখেছে। একটা শব্দ তুমি করেছছা তো জানে মেরে ফেলবো, সে ফার্সী ভাষায় কথাটা বলে। আমার কথা বুঝতে পেরেছো? সে যখন মাথা নাড়ে তার তরুণ চোখ ভয়ে বিস্ফারিত হয়ে রয়েছে। বেশ এখন তাহলে তোমার মনিব শের আফগান যেখানে ঘুমিয়ে আছে আমাকে সেখানে নিয়ে চলো।’
তরুণ প্রহরী আবার মাথা নাড়ে। সে বাম হাতে অসহায় তরুণের গলার পেছনের দিক এত জোরে আঁকড়ে ধরে যে তার নখ বেচারার মাংসের গভীর প্রবেশ করে, এবং ডান হাতে মোষের চামড়ার ময়ান থেকে বাকান ফলার তুর্কী খঞ্জরটা বের করে, বার্থোলোমিউ ভেতরের আঙিনার উপর দিয়ে তাকে অনুসরণ করে কোণায় অবস্থিত একটা দরজার নিচে দিয়ে এগিয়ে যায় এবং কয়েক ধাপ পাথুরে সিঁড়ি অতিক্রম করে একটা লম্বা করিডোরে এসে উপস্থিত হয়। সে টের পায় তার আঁকড়ে ধরা হাতের ভিতরে ভয় পাওয়া ভীত কুকুরছানার মত তরুণ প্রহরী কাঁপছে।
‘মহাশয়, এখানেই। এটাই সেই কামরা।’ পিতলের ব্যাঘ্র বসান কালো কোনো কাঠের তৈরি ভীষণ চকচকে দরজাবিশিষ্ট একটা কক্ষের বাইরে ছেলেটা এসে থামে। বার্থোলোমিউর মনে হয় সে মশলাযুক্ত কোনো সুগন্ধ। তাঁর নাকে পেয়েছে–সম্ভবত কুন্দু–এবং সে তরুণ ছেলেটাকে আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরতে, আতঙ্কিত খয়েরী চোখে, সে ঘুরে তাকায়। সে কোনো হুশিয়ারি না দিয়েই চিৎকার করে বিপদসঙ্কেত দিতে মুখ হাঁ করে।
বার্থোলোমিউ বিন্দুমাত্র ইতস্তত করে না। সে চোখের পলকে দু’বার হাত চালিয়ে বাম হাতে ছেলেটার মাথা পেছনের দিকে টেনে আনে এবং একই সাথে তার উজ্জ্বল ফলাযুক্ত তূর্কী খঞ্জর ধরা ডান হাতটা উঁচু করে আর মসৃণ ত্বকযুক্ত গলায় চালিয়ে দেয়। উন্মুক্ত ক্ষতস্থান দিয়ে তরুণ প্রহরীর শেষ নিঃশ্বাস বুদ্বুদের মত বের হতে সে নিথর দেহটা মাটিতে নামিয়ে রাখে। পরিস্থিতি ভিন্ন হলে, সে হয়ত তাকে প্রাণে বাঁচিয়ে রাখতো, কিন্তু এখানে সেই উদারতা দেখাবার কোনো স্থান নেই যেখানে নিজের কোনো ভুলের খেসারত তাকে নিজের জীবন দিয়ে দিতে হতে পারে। সহজাত প্রবৃত্তির বশে সে খঞ্জরের ফলাটা নিজের আলখাল্লায় মুছে নেয়। তার সমস্ত চিন্তা জুড়ে এখন কেবল একটাই ভাবনা দরজার চকচক করতে থাকা ব্যাঘ্রখচিত পাল্লার অপর পাশে সে কি দেখতে পাবে। সে শুনেছে যে ‘শের’ মানে ব্যাঘ–যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে সে ঠিক জায়গায় পৌঁছেছে এবং শের আফগান মাত্র কয়েক ফিট দূরে রয়েছে।
তার ডান হাতে তখনও খঞ্জর ধরে রেখে, বার্থোলোমিউ বামহাতে ডানপাশের পাল্লার–এটাও আবার বাঘের মতই দেখতে–কারুকার্যখচিত ধাতব অর্গলটা সতর্কতার সাথে নামিয়ে আলতো করে কৌতূহলী একটা ধাক্কা দেয়। দরজার পাল্লাটা নিরবে আর মসৃণভাবে খুলে যেতে সে দারুণ। স্বস্তি পায়। পাল্লাটা যখন ছয় ইঞ্চির মত ফাঁক হয়েছে সে ধাক্কা দেয়া বন্ধ করে। ধুসর সোনালী আলোর একটা স্রোত তাকে জানায় সে যেমনটা আশা করেছিল তেমন অন্ধকার একটা কক্ষে সে প্রবেশ করতে যাচ্ছে না। শের আফগান সম্ভবত দরজার পাল্লাটা ইতিমধ্যেই খুলে যেতে দেখেছে এবং এখন নিজের তরবারি হয়ত কোষমুক্ত করছে…