এম্পায়ার অব দি মোগলের পঞ্চক উপন্যাসের প্রথম তিনটি উপন্যাসের মত, এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্রগুলো–রাজকীয় মোগল পরিবার, পারস্যের গিয়াস বেগ এবং তাঁর সমস্ত পরিবার যাদের ভিতরে মেহেরুন্নিসা এবং আরজুমান্দও রয়েছে, সুযোগ সন্ধানী মহবত খান, আবিসিনিয়ার সেনাপতি আর প্রাক্তন দাস মালিক আম্বার এবং টমাস রো’র মত আরো অনেকের–অস্তিত্ব রয়েছে। কিছু সহায়ক চরিত্র যেমন সুলেমান বেগ, নিকোলাস ব্যালেনটাইন এবং কামরান ইকবাল বাস্তব চরিত্রের উপর আধারিত হলেও আসলে কল্পিত চরিত্র।
প্রধান ঘটনাসমূহ–খসরুর বিদ্রোহ, মালিক আম্বারের বিরুদ্ধে খুররমের অভিযানসমূহ, এবং তার আব্বাজানের কাছ থেকে তাঁর বিচ্ছেদ, মহবত খানের অভ্যুত্থান–অবশ্য সত্যি ঘটনা যদিও আমি কিছু পরিবর্তন অথবা পরিবর্ধন করেছি এবং কোনো কোনো স্থানে ঘটনাবলি সংকুচিত আর সময়সীমা পরিবর্তন করেছি। জাহাঙ্গীর বাস্তবিক মেহেরুন্নিসার প্রতি, যাকে পরবর্তীতে নূর জাহান হিসাবে সবাই চিনবে, মোহাবিষ্ট ছিলেন যিনি নিজের প্রভাব খাটিয়ে ব্যক্তিগত ক্ষমতা লাভ করেন এবং কার্যত হিন্দুস্তানের শাসক হয়ে উঠেন–সেই সময়ের একজন রমণীর পক্ষে যা একটা অবিস্মরণীয় অর্জন। একটা ব্যাপার বিস্ময়কর যে যখন রাজঅন্তঃপুরের মহিলাদের চিত্রকর্ম খুব অল্প দেখা যেত তখন মেহেরুন্নিসার বেশ কয়েকটা প্রতিকৃতি যার ভিতরে একটার বর্ণনা এই উপন্যাসে রয়েছে এখনও টিকে আছে। সূত্র অনুযায়ী এটা স্পষ্ট যে মেহেরুন্নিসা প্রথমে নিজের ভাস্তি আরজুমান্দের বিয়ে খুররমের সাথে দেয়ার জন্য সহায়তা করে কিন্তু তারপরে তাঁদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। গল্পের গতিময়তার জন্য খানিকটা কল্পনার অবতারণা জরুরি। স্যার টমাস রো রাজত্বের একটা সুন্দর খণ্ডচিত্র দান করেছে যেখানে শেকসপিয়রীয় বিষাদের সমস্ত উপকরণসহ উপস্থিত: একজন অভিজাত রাজপুরুষ, একজন বিদূষী স্ত্রী, একজন বিশ্বস্ত পরামর্শদাতা, একজন কুটিল সৎ-মা, একজন উচ্চাকাঙ্খি সন্তান, একজন ধূর্ত প্রিয়পাত্র…’ আর প্রায়শই মহান বিষাদগাঁথায় যে অন্তর্নিহিত বার্তা মূর্ত হয়ে সেটা হল–যে মূল চরিত্রগুলো তাদের নিজেদের বিনাশের রূপকার হয়ে উঠে।
উপন্যাসটা লেখার সময় সবচেয়ে পরম আনন্দের বিষয় ছিল গবেষণার জন্য ভারতবর্ষে ভ্রমণের সময় অতিবাহিত সময়টা। খুররমের মত আমি দক্ষিণে দাক্ষিণাত্যে গিয়েছি, নর্মদা নদী অতিক্রম করেছি এবং বেলেপাথরের আসিরগড় দূর্গের পাশ দিয়ে ক্ষয়াটে সোনালী পাহাড়ী ভূ-প্রকৃতির ভিতর দিয়ে ভ্রমণ করেছি। আমার গন্তব্যস্থল ছিল তাপ্তি নদীর তীরে বুরহানপুরের দূর্গ-প্রাসাদ-দাক্ষিণাত্যের সালতানের বিরুদ্ধে যা একটা সময় মোগলদের অগ্রবর্তী নিয়ন্ত্রক কেন্দ্র ছিল এবং এই স্থানে অনেক বিয়োগান্তক আর অশুভ ঘটনার জন্ম হয়েছে। ধ্বংসপ্রাপ্ত ভগ্নস্তূপের মাঝে হেঁটে বেড়াবার সময় যেখানে একটা সময় মার্বেলের নহর দিয়ে চমৎকার ফ্রেসকো অঙ্কিত হাম্মামে পানি প্রবাহিত হতো আর খুররমের রণহস্তি একসময়ে হাতিমহলে যেখানে বিচরণ করতো সেখানে আমি মাঝে মাঝে মোগলদের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারি।
যোধপুরের কাছে আমি আফিমের তিক্ত স্বাদযুক্ত পানি গ্রামের একজন বয়স্ক লোকের অঞ্জলি থেকে পান করেছি যা রাজপুত যোদ্ধাদের অবশ্যই যুদ্ধের পূর্বে পান করতে হয়। আগ্রায় আমি আমার পুরাতন জ্ঞান আবারও ঝালিয়ে নেই–লাল কেল্লা যেখানে একটা পাথরের খণ্ড থেকে প্রস্তুত জাহাঙ্গীরের পাঁচ ফিট উঁচু গোসলের আধার যা ভ্রমণের সময় সবসময়ে তার সঙ্গে থাকতো দূর্গ প্রাঙ্গণে এখনও রয়েছে; গিয়াস বেগের মার্বেলের কারুকাজ করা সমাধি যা মেহেরুন্নিসা তৈরি করেছেন, যা ইতিমাদ-উদ-দৌলার সমাধি’ হিসাবে পরিচিত; কাছেই সিকান্দ্রা অবস্থিত যেখানে মহামতি আকবরের অতিকায় বেলেপাথরের সমাধিসৌধ অবস্থিত যা জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে সমাপ্ত হয়; চম্বল নদী আর নদীর বিপুল সংখ্যক ‘ঘড়িয়াল (মাছখেকো কুমীর), সারস আর শুশুক। সেই সাথে সুযোগ হয়েছিল জাহাঙ্গীরের প্রিয় রসালো আম আর ঝাল রাজস্থানী লাল মাস খাওয়ার–মরিচ দিয়ে রান্না করা ভেড়ার মাংস এই সময়েই আনারস আর আলুর মত নতুন পৃথিবী থেকে মরিচও ভারতবর্ষে আসতে শুরু করেছে।
আমি ভ্রমণ করার সময় মোগল বাহিনীকে বিশাল ধূলোর মেঘের জন্ম দিয়ে যেন অবারিত ভূপ্রকৃতির মাঝে ধীরে কিন্তু নিশ্চিত ভঙ্গিতে এগিয়ে যেতে দেখি। আমি রাতের বেলা তাদের শিবিরে তাবু খাটাতে দেখি যার আকৃতি একটা প্রায় ছোট শহরের মত এবং পরিচারকেরা তুলার বিচি আর তেল বিশাল একটা পাত্রে পূর্ণ করে সেটা বিশ ফিট উঁচু একটা দণ্ডের উপর স্থাপন করছে সেটা অগ্নি সংযোগ করতে–আকাশ দিয়া, আকাশের আলো–রাতের আকাশে যা উপরের দিকে আগুনের শিখা ছড়িয়ে দেয়। আমি গোবরের ঘুঁটে দিয়ে জ্বালান হাজার রান্নার আগুন থেকে ভেসে আসা তিক্ত গন্ধ যেন টের পাই এবং বাদ্যযন্ত্রীদের বাজনার সুর শুনতে পাই যারা সবসময়ে আগুয়ান মোগল বাহিনীর সঙ্গে থাকতো। খুররম আর জাহাঙ্গীর যদিও প্রায় চারশ বছর পূর্বে জীবিত ছিল, কিন্তু কোনো কোনো সময় তাদের পৃথিবী আর তারা যেন আমাদের আশেপাশেই বিরাজ করতে থাকে।