আকবরকে মহান আর ন্যায়পরায়ন শাসক হিসাবে, যাকে তার সব প্রজা ভালোবাসে, তাদের ধর্ম গোত্র বা মর্যাদা যাই হোক না কেন, অতিক্রম করা যদি কঠিন হয় তাহলে সে সংকল্পবদ্ধ তাকে রাজকীয় পরিবারের প্রধান হিসাবে সে ছাপিয়ে যাবে। আকবরের সাথে তাঁর সন্তানদের সম্পর্ক বিভেদপূর্ণ আর দূরবর্তী ছিল, ঠিক জাহাঙ্গীরের সাথে তাঁর নিজের যেমন সম্পর্ক ছিল। উভয় পুরুষেই–এবং তার আগে হুমায়ুনের সময়ে সৎ-ভাইয়েরা পরস্পরের সাথে সিংহাসনের অধিকারের জন্য লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতো। আকবরের মত না তাঁর নিজের একটা একতাবদ্ধ আর ভালোবাসাপূর্ণ পরিবারের অধিকারী হবার সৌভাগ্য হয়েছে এবং সে চেষ্টা করবে এটা যেন সেভাবেই থাকে। তার পুত্র আর কন্যারা একই মায়ের সন্তান এবং তাদের যে দুর্ভোগ সহ্য করতে হয়েছে সেটা তাঁদের পরস্পরের আরো কাছে নিয়ে আসায়, রাজবংশকে রূপান্তরিত করতে এগুলো তাকে সাহায্য করবে। দারা শুকোহ আর আওরঙ্গজেব যারা একসঙ্গে বন্দিত্ব বরণ করেছে। কীভাবে পরস্পরের সাথে লড়াই করবে? ভয়ঙ্কর পারিবারিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা পুরাতন ঐতিহ্যবাহী তক্তা তখতের রীতি, সিংহাসন বা শবাধার, যা পূর্ববর্তী বংশধরদের কালিমালিপ্ত করেছে এবং সাম্রাজ্যকে গৃহযুদ্ধের হুমকির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে–চিরতরে লোপ পাবে।
তারচেয়েও বড় কথা, সে নিজেকে আর নিজের পরিবারকে তাঁর রাজবংশের অন্যান্য দুর্বলতা থেকে দূরে রাখবে–আফিম আর সুরার প্রতি মাত্রাতিরিক্ত দুর্বলতা যা তাঁর আব্বাজানের মনকে দুর্বল করে ফেলেছিল আর তার প্রপিতামহ হুমায়ুনকেও এবং তাঁদের পরিবারের অসংখ্য সদস্যকে অকালে সমাধি চিনিয়েছে–তার সৎ-ভাই পারভেজ এবং তাঁর চাচাজান দানিয়েল এবং মুরাদ। তাঁর প্রথম কাজ হবে নিজের জন্য এবং নিজের পরিবারের জন্য সুরা বর্জনের ঘোষণা দেয়া, যদিও তার পূর্বের আকবর আর বাবরের মত সে নিজেকে এসব মাদকের উপর প্রভুত্ব করার মত শক্তিশালী মনে করে এবং তাঁদের দাস নয়।
ঢাকের একটা প্রলম্বিত বাজনা ইঙ্গিত দেয় যে খুররমকে বহনকারী হাতির থামার সময় হয়েছে এবং প্রাণীটা হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে। কিছুক্ষণের ভিতরেই সে নিচে নামবে এবং তার ছেলেদের সাথে নিয়ে সিংহাসনের দিকে এগিয়ে যাবে যখন আরজুমান্দকে আর তার কন্যাদের বহনকারী হাতি তাঁদের হেরেমে নিয়ে যাবে। মেয়েদের দর্শনকক্ষ থেকে আরজুমান্দ, তাঁর ভালোবাসা এবং তার সমস্ত বিপর্যয়ের মাঝে তার একমাত্র স্বস্তির জায়গা, জালি তিরস্করণীর ভিতর দিয়ে তাকে প্রথমবারের মত তার দরবারের সামনে ভাষণ দিতে দেখবে। তার রাজত্বকাল শুরু হতে চলেছে। রক্তপাতের মাধ্যমে যদিও এর সূচনা হয়েছে, আরজুমান্দকে সাথে নিয়ে সে একে নিশ্চিতভাবেই গৌরবের মাঝে সমাপ্ত করবে…
৩. ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা
জাহাঙ্গীর তাঁর প্রপিতামহ বাবরের মত নিজের স্মৃতিকথা–তুজুকে-ই জাহাঙ্গীরি–লিখেছিল যা তিনি ১৬০৫ সালে লিখতে শুরু করেন, যে বছর সম্রাট হিসাবে তাঁর অভিষেক হয়। বাবরের চেয়ে একেবারেই ভিন্ন একটা পৃথিবীর বর্ণনা তিনি দিয়েছেন, জাহাঙ্গীরের স্মৃতিকথাও প্রাণবন্ত আর বিশদ এবং অনেকক্ষেত্রেই ভীষণ ভোলামেলা। তাঁর স্মৃতিকথায় আমরা বিরোধিতায় আকীর্ণ একজন মানুষকে খুঁজে পাই–তিনি কখনও চাম্পা ফুলের জটিল সৌন্দর্য কবিতার ছন্দে বর্ণনা করছেন বা আমের চমৎকার স্বাদের কথা বলছেন আবার পরমুহূর্তেই স্বীকার করছেন তিনি তার আব্বাজানের বন্ধু আর পরামর্শদাতা আবুল ফজলকে খুন করিয়েছেন কারণ তিনি তাঁর বন্ধু ছিলেন না। আরেকটা দীর্ঘ আর তিক্ত পরিচ্ছেদে তিনি নিজের একসময়ের প্রিয় পুত্র খুররমের কাছ থেকে বিচ্ছেদের বর্ণনা দিয়েছেন, অবজ্ঞাভরে তাকে সম্বোধন করেছেন যে অমঙ্গলের বার্তাবাহী এবং বি-দৌলত, বদমাশ’ হিসাবে। মেহেরুন্নিসার প্রতি তার ভালোবাসা স্পষ্ট। তিনি একটা পরিচ্ছদে তিনি বর্ণনা করেছেন কীভাবে একটা খাটিয়ার উপর থেকে এক গুলিতে মেহেরুন্নিসা একটা বাঘ শিকার করেছিল যা, তিনি লিখছেন ভীষণ কঠিন একটা কাজ। ১৬২২ সালে, ক্রমশ দুবর্ল হয়ে পড়ায় জাহাঙ্গীর তাঁর স্মৃতিকথা লেখার দায়িত্ব মুতামিদ খানকে, তার একজন লিপিকার, দেন যিনি মহবত খানের বিদ্রোহের সময় উপস্থিত ছিল। তিনি বিশ্বস্ততার সাথে ১৬২৪ সাল পর্যন্ত স্মৃতিভাষ্য লেখা বজায় রাখেন এবং তারপরে নিজের ভাষ্য লিখেন-ইকবাল-নামা-জাহাঙ্গীরের জীবনের শেষ তিনবছরের কথা। এসব ছাড়াও আরও কিছু দিনপঞ্জি রয়েছে যেমন ফারিশতা’র গুলশান-ই-ইব্রাহিম যা জাহাঙ্গীরের জীবনের আংশিক বিবরণ। শাহজাহাননামার মত দিনপঞ্জি খুররমের কথা শোনায়।
জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে বেশ কয়েকজন বিদেশী পর্যটক হিন্দুস্তান এসেছিল তাঁরা যা প্রত্যক্ষ করেছে সেসব প্রাণবন্তভাবে বর্ণনা দিয়েছে। স্যার টমাস রো, মোগল দরবারে আগত প্রথম ইংরেজ প্রতিনিধি, লিখিত পুস্তক বিস্তারিত বর্ণনায় ঠাসা এবং অনেক সময় সেখানে পক্ষপাতিত্বের সুর থাকলেও মোগল দরবারের জৌলুস দেখে একজন ইউরোপীয়ের বিস্ময় সেখানে ঠিকই টের পাওয়া যায়। অন্যান্য তথ্যসূত্রের ভিতর রয়েছে হিন্দুস্তানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী প্রেরিত উইলিয়াম হকিন্সের লেখা, যিনি আগ্রা জাহাঙ্গীরের দরবারে ১৬০৯ সাল থেকে ১৬১১ সাল পর্যন্ত অবস্থান করেছিলেন; উইলিয়াম ফিঞ্চ, হকিন্সের সহকারী, যিনি আকবরের রক্ষিতা আনারকলির, ‘ডালিম সুন্দরী’ গল্পের উৎস; এডোয়ার্ড টেরী, একজন পাদ্রী যিনি রো’র চ্যাপলিন ছিলেন কিছু সময়ের জন্য এবং তার সাথেই ইংল্যান্ডে ফিরে যান; এবং বিখ্যাত ইংরেজ পর্যটক টমাস ক্রোয়েট যিনি স্থলপথে হিন্দুস্তানে এসেছিলেন এবং ১৬১৫ সালে জাহাঙ্গীরের দরবারে উপস্থিত হন। তিনিই জাহাঙ্গীরের হাতির চোখ ধাঁধানো অলঙ্কারের বর্ণনা দেন যা ভিতরে রয়েছে। তাদের নিতম্বের জন্য সোনার তৈরি আসবাব।