তাকে বহনকারী হাতি আবার সূর্যালোকে বের হয়ে এসে, তাকে সিংহাসনের দিকে নিয়ে যেতে থাকলে যার জন্য সে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করেছে, ভাবনাগুলো আবার ফিরে আসে। কেন? কারণ সে অপরাধবোধ করছে? না। শাহরিয়ার আর খসরুর মৃত্যুর প্রয়োজন ছিল, নয় কি? রাজত্বের শুরু সামান্য রক্তপাত কি ভালো নয় পরে প্রচুর রক্তপাতের চেয়ে কারণ তাঁর সেটা করার মত সাহস নেই? তাঁদের মৃত্যুর ফলে প্রাপ্ত সুবিধা কি তাদের মৃত্যুজনিত পাপের চেয়ে বেশি নয়? হ্যাঁ, সে নিজেকে আবার স্মরণ করিয়ে দেয়। সে এইসব মৃত্যুর সাহায্যে সিংহাসনের সম্ভাব্য প্রতিপক্ষকে চিরতরে পরাস্ত করেছে এবং নিজেকে আর নিজের পরিবারকে রক্ষা করেছে।
অনেক হয়েছে, খুররম নিজেকে বলে। সে তাই করেছে যেটা তাঁর করা উচিত ছিল এবং অতীত হল ঠিক তাই–অতীত। বর্তমান আর ভবিষ্যতই হল গুরুত্বপূর্ণ আর সে নিজের কর্মকাণ্ডের দ্বারা দুটোই নিরাপদ করেছে। নিজেকে সুস্থির করার চেষ্টা করে সে চারপাশে তাকিয়ে তাকে অনুসরণরত বিশাল শোভাযাত্রাটা লক্ষ্য করে। তাঁর চার সন্তানকে, রাজবংশের রাজপুত্রদের, বহনকারী হাতিটায় তারা রেশমের একটা সবুজ চাঁদোয়ার নিচে রয়েছে আর আরেকটু ছোট আরেকটায় আরজুমান্দ আর তাদের দুই কন্যার হাওদা রূপার জরির তৈরি কাপড়ের পর্দা দিয়ে ঘেরা যার ভেতরে সোনার তারের জালি বসান রয়েছে যাতে তারা ভেতর থেকে সবকিছু দেখতে পায় তার ঠিক পেছনেই রয়েছে। আরজুমান্দের পিতা আসফ খান বিশাল একটা সাদা স্ট্যালিয়নে উপবিষ্ট অবস্থায় এরপরেই রয়েছেন আর কারুকাজ করা পর্যাণের কাপড়যুক্ত কালো স্ট্যালিয়নে বসে মার্জিত ভঙ্গিতে জনগণকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে মহবত খান, এখন তাঁর খান-ই-খানান, প্রধান সেনাপতি। তারপরে রাজকীয় দেহরক্ষীদের অনুসরণ করছে অশ্বারোহী যোদ্ধার দল পাশাপাশি চারজন অবস্থান করে এগিয়ে চলেছে–যাঁদের অনেকেই লাল-পাগড়ি পরিহিত রাজপুত যোদ্ধা–এবং সবশেষে রয়েছে তবকি আর তীরন্দাজেরা, সবাই মোগল সবুজ রঙের পোষাকে দারুণভাবে সুসজ্জিত, সবাই অজেয় একটা বাহিনীর সদস্য যা এখন তাঁর নেতৃত্বাধীন।
দৃশ্যটা খুররমের মাঝে আস্থা ফিরিয়ে আনে। উপরের দূর্গে পরিচারকেরা দূর্গ প্রাকারের উপরে দৌড়াদৌড়ি করছে, সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে সোনার আর রূপার মোহর–টাকশাল থেকে নতুন তৈরি করা তাঁর রাজত্বের সূচনা ঘোষিত করতে–আর অল্পদামী পাথর–বৈদুর্যমণি, টোপাজ প্রভৃতি নিক্ষেপ করতে। রূপা আর সোনার পাতলা পাত দিয়ে তৈরি চাঁদ আর তারার প্রতিকৃতি অন্য পরিচারকেরা বাতাসে ছুঁড়ে দিচ্ছে। পুরো ব্যাপারটা দেখে মনে হবে বেহেশত থেকে যেন পৃথিবীর উপরে ধনসম্পদ বর্ষিত হচ্ছে–মোগল ধনসম্পদ। সে এসব কিছুর মালিক এবং তার ক্ষমতা আর সম্পদ সবকিছুকে আরও মহিমান্বিত করবে। সে কয়েকটা বিদ্বেষপূর্ণ শব্দের কারণে নিজেকে অস্থির করে তুলবে না।
দ্বিতীয় আরেকটা তোরণের নিচ দিয়ে অতিক্রম করে খুররম ফুলের পাপড়ি দিয়ে ঢাকা আঙিনার মাঝে আকবরের তৈরি করা ঝর্ণাগুলোকে দেখতে পায় এবং এর পেছনেই বহু স্তম্ভযুক্ত দেওয়ানি আম যেখানে মার্বেলের বেদীর উপরে সোনার তৈরি সিংহাসনটা স্থাপিত। তাঁর প্রধান অমাত্যরা ইতিমধ্যেই বেদীর নিচে অগ্রগণ্যতার বিন্যাস অনুসারে সমবেত হয়েছে। আর কয়েক মুহূর্ত পরেই সে ঐ সিংহাসনে নিজের আসন গ্রহণ করবে এবং প্রথমবারের মত তাঁর দরবারের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবে। রক্তপাত ঘটিয়ে সে যদি পাপ করে থাকে তাঁর প্রজাদের কাছে সে এই কারণে অনেকবেশি প্রায়শ্চিত্ত করবে। সে তাঁদের কাছে প্রমান করবে সিংহাসন আর তাঁদের ভালোবাসা তারই প্রাপ্য এবং তাদের পুলকিত করবে যে সে তাঁদের সম্রাট।
তাঁর দাদাজান আকবরের কয়েকটা বাক্য তাঁর মনে পড়ে যায়। মানুষ প্রদর্শন পছন্দ করে এবং নিজেদের শাসকেরা দ্বারা প্রভাবিত হতে আর তাদের জন্য সম্ভম অনুভব করতে চায়। একজন মহান শাসককে সূর্যের মত হতে হবে–চোখ তুলে তাকালে চোখ ধাধিয়ে যাবে আবার সব আলো আর আশা এবং উষ্ণতার উৎস যা ছাড়া অস্তিত্বের সম্ভাবনাই অসম্ভব। আকবর সত্যিকার অর্থেই জাঁকজমকপূর্ণ ছিলেন। কিন্তু সে, খুররম তাকে অনুসরণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করবে, তার অর্জনের সমকক্ষ হতে আর সম্ভব হলে সেটা ছাড়িয়ে যেতে চেষ্টা করবে। সে তাঁর আব্বাজান একসময়ে তাকে যে উপাধি দান করেছিলেন সেই শাহ জাহান, পৃথিবীর অধিশ্বর নাম নিয়ে রাজত্ব পরিচালনা করবে। সোনার তৈরি সিংহাসন যে কিছুক্ষণের ভিতরেই যার উপরে উপবিষ্ট হবে সেটা পৃথিবীর অধিশ্বরের জন্য যথেষ্ট জমকালো নয়। সে ইতিমধ্যেই তাঁর সম্পদের সিন্দুক পরিদর্শন করেছে যেগুলো এত প্রচুর সংখ্যক উজ্জ্বল রত্নপাথরে পরিপূর্ণ যে তাঁর কোষাগারের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকদের পক্ষে সেগুলো গণনা করা অসম্ভব তারা তাই সেগুলো কেবল ওজন করে যাতে তারা তাকে বলতে পারে, দেখেন জাহাপনা এখানে আপনার আধ টন হীরক রয়েছে এবং এখানে একটন পরিমাণ মুক্তা…’ সে সাম্রাজ্যের সেরা মণিকারকে ডেকে পাঠাবে এমন একটা সিংহাসন তৈরির জন্য যেখানে তার সবচেয়ে উজ্জ্বল রত্নগুলো প্রদর্শিত হবে। সে একটা রত্নখচিত চাঁদোয়ার নিচে উপবেশন করবে যা পদ্মরাগমণি খচিত স্তম্ভের উপর শোভা পাবে। চাঁদোয়ার উপরে একটা বৃক্ষ থাকবে যা জীবনের স্মারক হিসাবে ফুটিয়ে তোলা হবে, যার কাণ্ডটা হবে হীরকের আর মুক্তার এবং এর উভয় পাশে থাকবে ঝলমলে পালক ছড়ান ময়ূর। সে তার তখন তাউসে বসে থাকার সময় এতটাই জ্বলজ্বল করবে যে আসলেই তার দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারবে না।