*
তিন রাত পরে, পরস্পরের সঙ্গসুখ উপভোগের পরে তাঁরা যখন পাশাপাশি শুয়ে আছে, আরজুমান্দ ধীরে উঠে বসে। তার মুখের উপর থেকে কালো চুলের একটা গোছা সরিয়ে সে খুররমের চোখের দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে। আমি কি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?
‘অবশ্যই।
আমরা যখন সিকান্দ্রা অভিমুখে এগিয়ে আসছিলাম, আমার এক পরিচারিকা আমায় এমন একটা কথা বলেছে যা বিশ্বাস করতে আমার রীতিমত কষ্ট হয়েছে–সে বুরহানপুর থেকে সদ্য আগত এক বার্তাবাহকের কাছ থেকে একটা গল্প শুনেছে। আমি গল্পটার কথা যতই ভুলতে চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুতেই সেটাকে মন থেকে দূর করতে পারছি না।’
‘কি গল্প? আরজুমান্দের কণ্ঠে এমন একটা সুর ছিল যা খুররমকে বাধ্য করে উঠে বসতে।
‘গল্পটা হল খসরুর পরিচারকেরা তাকে তার কক্ষে একদিন সকালে মৃত অবস্থায় খুঁজে পেয়েছে যেখানে তাকে আপনি বন্দি করে রেখেছিলেন।
খুররম কোনো কথা না বলে একমুহূর্ত চুপ করে থাকে। তারপরে: ‘গল্প নয় সত্যি। আমার সৎ-ভাই মারা গিয়েছে, সে আবেগহীন কণ্ঠে বলে।
‘কিন্তু গল্পটা হল তাকে আপনার আদেশে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে।’
খুররম আবারও চুপ করে থাকে। দ্বিতীয় চিঠিটায়–বুরহানপুরের সুবেদারের কাছে যেটা সে পাঠিয়েছিল–খসরুকে যতটা কম কষ্ট দিয়ে সম্ভব হত্যা করার আদেশ ছিল। সে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আদেশটা দিয়েছিল কিন্তু সে নিশ্চিত ছিল যে নিজের স্বার্থে তার পরিবারের মঙ্গলের জন্যই তাকে এটা করতে হবে। কিন্তু পরবর্তীতে সে যখন সংবাদের জন্য অপেক্ষা করছে যে তার অভিপ্রায় পালিত হয়েছে, সে কল্পনা করতে শুরু করে খসরুর কি অনুভূতি হয়েছিল নিজের কক্ষের দরজা অপ্রত্যাশিতভাবে খুলে যেতে… নিজের আংশিক প্রতিবন্ধী দৃষ্টি নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে… ভাবতে চেষ্টা করছে তার সাথে কারা দেখা করতে এসেছে… হয়তো ভেবেছিল তাঁর স্ত্রী জানি বুঝি এসেছে। তার সৎ-ভাই কখন বুঝতে পারে খোলা দরজা দিয়ে প্রেমময় স্ত্রী নয় হন্তারক আততায়ী প্রবেশ করেছে? খসরু কীভাবে মারা যায়? তার একমাত্র আদেশ ছিল মৃত্যু যেন ব্যাথামুক্ত হয়। তরবারির ফলার দ্রুত আঘাত নাকি বুকের গভীরে খঞ্জরের মারাত্মক খোঁচায় সেটা সম্পন্ন হয়েছে? বিষের পাত্র থেকে জোর করে অনিচ্ছুক ঠোঁটে পান করার হয়েছে নাকি বালিশ দিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করা হয়েছে?
সে অবশ্য, একটা বিষয় অনুধাবন করে প্রয়োজনের উপরে আবেগকে স্থান দেয়া ঠিক হবে না আর এভাবে চিন্তা করাও। খসরু তার অবশ্যই একজন সম্ভাব্য আর বিগত বিদ্রোহী হিসাবে বিবেচনা করতে হবে–একজন জীবন্ত। আর অনুভূতিশীল মানুষ হিসাবে নয়। কিন্তু পরে, শ্বাসরুদ্ধ হয়ে খসরুর মৃত্যুর খবর যখন তার কাছে পৌঁছায়, একটা নতুন উদ্বেগ তার মাঝে জন্ম নেয়। শাহরিয়ারকে নিয়ে তাঁর সামনে মেহেরুন্নিসা দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় যা বলেছিল সেই কথাগুলো তাকে আসলেই কতটা প্রভাবিত করেছে? সে। কি তার অনুভূতি নিয়ে খেলা করেছিল যখন সেগুলো নিজের বিজয়ে আর সন্তানদের সাথে একত্রিত হবার কারণে টানটান অবস্থায় ছিল এবং সুযোগ বুঝে তাকে এমন কিছু একটা করতে বাধ্য করেছে যার জন্য সে সারা। জীবন অনুতপ্ত হবে ঠিক যেভাবে সে তার আব্বাজানকে প্রভাবিত করতো? না, সে নিজেকে আবার জোর করে বোঝায়। সে নিজে কেবল এই অবশ্যম্ভাবী সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর সেটা যুক্তিসঙ্গত ছিল।
‘আমি তোমায় মিথ্যা বলতে পারবো না। সবই সত্যি। কিন্তু আমি আমাদের আর আমাদের সন্তানদের রক্ষা করার জন্য এসব করেছি। খুররম চুপ করে থাকে তারপরে জোর করে আবার বলতে থাকে। আর আরো কিছু রয়েছে… যার সম্বন্ধে আমি মাত্র গতকালই জানতে পেরেছি। খসরুর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আয়োজন সম্পন্ন করে, জানি নিজের কক্ষে ফিরে গিয়ে আত্মহত্যা করেছে–বলা হয়েছে যে শীতের প্রকোপ থেকে তাঁর কক্ষকে উষ্ণ রাখতে যে জ্বলন্ত কয়লার পাত্র ছিল সেখান থেকে সে জ্বলন্ত কয়লা ভক্ষণ করেছে।
আরজুমান্দের চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠে এবং সে মাথা নাড়তে থাকে। ‘খুররম, আপনি এটা কীভাবে করলেন? মৃত্যুবরণের কি নির্মম উপায়। আমি নিজেই যেন গলায় জ্বলন্ত কয়লার উত্তাপ অনুভব করছি সবকিছু পুড়ে যাচ্ছে, আমার ফুসফুস ঝলসে দিচ্ছে। নিজের অন্তিম মুহূর্তে কি ভয়ঙ্কর, ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা তাকে ভোগ করতে হয়েছিল।
জানির মৃত্যু–বিশেষ করে যেভাবে সেটা হয়েছে–তাকেও আবেগআপ্লুত করে তুলেছিল যখন সে প্রথম খবরটা শুনে, কিন্তু সে কেবল কোনোমতে বলে, আমি তাকে মারবার আদেশ দেই নি।
‘কিন্তু খসরুকে হত্যা করার জন্য আপনার আদেশের ফলেই এটা হয়েছে… আমি আপনাকে যেমন ভালোবাসি জানিও তাকে ঠিক তেমনই ভালোবাসতো। একজনের জীবন নেয়া পাপ, আমি জানি, এবং আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করি যে আপনি মারা যাবার পরে আমি যেন আমার সন্তানদের খাতিরে বেঁচে থাকার সাহস দেখাতে পারি, কিন্তু আমি বুঝতে পারছি কতটা শোক তাকে আপ্লুত করেছিল।
খুররম আরজুমান্দের বিহ্বল মুখের দিকে তাকায়। সে এইমাত্র যা বলেছে তা সত্যি। তার কারণেই জানির মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু সে যতই সন্দিহান হোক–কিংবা অপরাধবোধ–তাকে সেসব থেকে মুক্ত হতে হবে এবং শক্ত থাকতে হবে। আমি সবকিছুই আমার সন্তানদের কথা ভেবে করেছি। তাঁরাই আমাদের ভবিষ্যত–আমাদের রাজবংশের ভবিষ্যত, সে বলে, নিজের মন থেকে নিজের জীবন আর শাসনকে নির্বিঘ্ন করতে সে এসব করেছে সেই চিন্তা জোর করে মন থেকে সরিয়ে দেয়। কিন্তু বাস্তবে বোধহয় সেই অভিপ্রায়গুলো মিলে যায়। অল্প মানুষই–এমন কি একজন সম্রাটও–তাদের মনের গহনে আর অভিপ্রায়ের মাঝে নিঃশঙ্কভাবে উঁকি দেয়ার মত শীতল সাহস রাখেন, সবাই নিজেদের কার্যকলাপের স্বপক্ষে বাগাড়ম্বরপূর্ণ সাফাই দিয়ে নিজেদের সাথে ছলনা করতেই পছন্দ করেন। ‘আমি দোয়া করি খসরু আর বিশেষ করে জানির যেন বেহেশত নসীব হয়, আরজুমান্দ বলে, আর আমি এটাও দোয়া করি যেন আল্লাহ আপনাকে মার্জনা করেন এবং আপনাকে বা আপনার সন্তানদের কোন শাস্তি না দেন।