‘মেহেরুন্নিসা, আপনার জন্য, রাজকীয় বিধবার কাছে যেমন প্রত্যাশিত আপনি সেভাবে নির্জনে আপনার শোক পালন করবেন। আমি আপনার জন্য একটা দূরবর্তী স্থান খুঁজে বের করবো যেখানে আপনি হয়তো আপনার ক্ষতি আর আপনার পাপের মাঝে মধ্যস্থতা করতে পারবেন এবং পৃথিবীর কর্মকাণ্ড দ্বারা কোনোভাবেই বিব্রত না হয়ে যা শীঘ্রই আপনার কথা বিস্মৃত হবে, আল্লাহর উপাসনায় মগ্ন থেকে পরপারের ডাকের জন্য অপেক্ষা করবেন।’
মেহেরুন্নিসাকে যখন নিয়ে যাওয়া হয় সে কোনো কথা বলে না। সে যা চেয়েছিল আরো একবার ঠিক তাই পেয়েছে। সে বেঁচে থাকবে। অবশ্য, তার নিয়তির বাস্তবতা যখন সে অনুধাবন করতে আরম্ভ করে তখন সে কল্পনা করতে শুরু করে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাবার চেয়ে এখনই কি মৃত্যুবরণ করাটা তার জন্য ভালো হতো। মৃত্যু অবধারিত। সে কেন তাকে এখন ডেকে নিয়ে এলো না যখন সে জানতো সেটা করতে পারবে? একবারের মত হলেও কি সে সাহস দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে? এটা এমন একটা প্রশ্ন যা তাকে তাড়িত করতে থাকবে।
*
সেই রাতে, রাজকীয় আবাসন এলাকায় বসে নিজের লোকদের উৎফুল্ল পানাহারের আওয়াজ শুনতে শুনতে খুররম মোমের আলোয় দুটো চিঠির মুসাবিদা করে। প্রথমটা আরজুমান্দের কাছে, দীর্ঘ আর প্রেমপূর্ণ এবং তাঁদের সন্তানদের নিরাপত্তা আর কীভাবে সে সিংহাসন নিরাপদ করেছে সেই সংবাদ। তার রাজধানীতে তাঁর অভিষেকের প্রস্তুতির জন্য যত শীঘ্রি সম্ভব সে তাঁদের অবশিষ্ট সন্তানদের নিয়ে আগ্রার বাইরে তার সাথে মিলিত হবার জন্য চিঠিটায় তাকে আসতে বলা হয়েছে। দ্বিতীয় চিঠিটার প্রাপক বুরহানপুরের সুবেদার এবং অনেক সংক্ষিপ্ত আর অনেকবেশি বিষণ্ণ।
*
তূর্যনিনাদের ঝঙ্কারে খুররম, আওরঙ্গজেব আর দারা শুকোহকে নিয়েআগ্রা থেকে পাঁচ মাইল দূরে সিকান্দ্রা গ্রামে অবস্থিত তাঁর শিবিরে লাল তাবুর ভেতর থেকে মাথা নিচু করে দ্রুত বের হয়ে আসে। তাঁর প্রিয় দাদাজান আকবরের সমাধিসৌধের কাছে–আকাশের বুকে ভেসে থাকা বিশাল বেলেপাথরের তোরণদ্বার নিম গাছের মাঝ দিয়ে দৃশ্যমান–সিকান্দ্রাকে খুররমের কাছে মনে হয় আগ্রায় তার বিজয়দীপ্ত প্রবেশের পূর্বে যাত্রাবিরতির সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান। অনাড়ম্বর সৈন্যদের তাবু আর সামরিক শৃঙ্খলায় পরিচালিত এটা কোনো সামরিক অভিযানের শিবির নয়, বরং একটা বিশাল তাবুর শহর যেখানে তাঁর বিজয় উদ্যাপনের উৎসব ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। তার তাবুর চারপাশে সবদিকে ছড়িয়ে থাকা অনুগত অভিজাত ব্যক্তি আর সেনাপতিদের তাবুর শীর্ষে সবুজ মোগল নিশান পতপত করে উড়ছে। দুই সপ্তাহ পূর্বে লাহোর থেকে তাঁর আগমনের পর থেকেই ভোজসভা আর মনোরঞ্জনের জন্য মক্তহস্তে ব্যয় করা হচ্ছে, আগ্রার কোষাগার থেকে, যার ব্যয় নির্বাহ করা হচ্ছে যার চাবি এখন তাঁর কাছে রয়েছে। অভিষেকের অপেক্ষায় অপেক্ষমান মোগল সম্রাটের ডাকে সাড়া দিয়ে অনুগত রাজাদের আগমনের ফলে প্রতিদিনই তাঁর শিবিরের আকার বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আর অবশেষে অন্য সবার চেয়ে যার আগমনের জন্য সে সবচেয়ে বেশি প্রতিক্ষায় ছিল ঘনিয়ে এসেছে। সে মধ্যাহ্নের উজ্জ্বল সূর্যালোকে আরজুমান্দকে তার যাত্রাপথের শেষ কয়েক মাইল বহন করে আনবার জন্য জাঁকজমকের সাথে সজ্জিত যে হাতি প্রেরণ করেছিল সেটার পান্না বসান রূপার হাওদা চিকচিক করতে দেখে। তাঁর হাতির সামনে মহবত খানের রাজপুত যোদ্ধাদের একটা দল রয়েছে আর পেছনে তার সন্তানের কোনো হাতিতে রয়েছে সে ঠিক বুঝতে পারে না যাঁদের ভিতরে রয়েছে তার সর্বকনিষ্ঠ পুত্র মুরাদ বকস যাকে সে এখনও দেখে নি। তাঁর পরিবার অবশেষে পুনরায় একত্রিত হচ্ছে এই ভাবনাটায় মোগল সিংহাসনে আরোহণের মুহূর্তের কথা সে যখন চিন্তা করে তারচেয়েও বেশি আনন্দে তাকে আপুত করে তুলে। সে আওরঙ্গজেব আর দারা শুকোহর দিকে তাকিয়ে হাসে, উভয়ের পরনে এই মুহূর্তের জন্য উপযুক্ত রূপার জরির কারুকাজ করা পাগড়ি আর কোট। তোমাদের আম্মাজান। তিনি আসছেন,’ সে মৃদু কণ্ঠে বলে।
আরজুমান্দের হাতির আগমন উপলক্ষ্যে হেরেমের তাবুর সামনে স্থাপিত প্রায় বিশ ফিট উঁচু চূড়াযুক্ত একটা তাবুর দিকে তাদের নিয়ে এগিয়ে যায়। আরজুমান্দকে বহনকারী হাতিকে তাঁর সোনালী রঙ করা কানের পেছনে বসে থাকা দুই মাহুত তাঁদের হাতের লোহার দণ্ডের সাহায্যে দক্ষতার সাথে বিশাল তাবুর দিকে নিয়ে আসবার সময় খুররম তার দুই সন্তানের কাঁধে হাত দিয়ে নিজেকে জোর করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করে। খুররম আর তার দুই সন্তানকে অনুসরণ করে অচিরেই হাতিটা তাবুর ভেতর করতে, পরিচারকেরা পর্দা আবার যথাস্থানে টেনে দেয়। খুররম অপেক্ষা করে যখন মাহুতেরা বিশাল প্রাণীটাকে হাঁটু মুড়ে বসায় এবং দ্রুত গলার উপর থেকে পিছলে নিচে নেমে এসে সোনার গিল্টি করা নামবার জন্য ব্যবহৃত কাঠের টুকরো জায়গামত স্থাপন করে যা প্রস্তুত অবস্থায় রাখা ছিল। তারপরে, পরিচারকেরা বুকে উপরে মুষ্ঠিবদ্ধ হাত রেখে তাদের দিকে মুখ করে পেছনে হেঁটে তাবু থেকে বের হয়ে যায়।
খুররম বুকে হৃৎপিণ্ড মাদলের বোল তুলে স্পন্দিত হতে থাকলে, সে ধীরে কাঠের খণ্ডের ধাপ বেয়ে উপরে উঠে মুক্তোখচিত সবুজ রেশমের পর্দা ধীরে টেনে সরায়। আরজুমান্দের চোখের দিকে তাকিয়ে সে কোনো কথা বলতে পারে না। হাওদার মাঝে ঝুঁকে এসে সে তাকে আলিঙ্গন করে তার উষ্ণ ওষ্ঠদ্বয় আশ্লেষে চুম্বন করে। আমি এই মুহূর্তটার জন্য কতদিন ধরে অপেক্ষা করছি…মাঝে মাঝে মনে হতো যে এটা বোধহয় আর কখনও আসবে না। কিন্ত এখানে আরো দু’জন রয়েছে যারা আমার চেয়েও দীর্ঘদিন অপেক্ষা করে রয়েছে, সে তাকে অবশেষে নিজের আলিঙ্গন থেকে মুক্তি। দেয়ার সময় ফিসফিস করে বলে। সে হাওদার রূপার দরজা খুলে দেয় এবং তাঁর মেহেদি রঞ্জিত হাত ধরে একসাথে ধাপ বেয়ে নিচে নামে। নিজের সন্তানদের দিকে তাকিয়ে ইতিমধ্যে তাঁর চোখ অশ্রু সজল হয়ে উঠতে আরম্ভ করেছে। তাররে, তাবুর ভেতরে প্রজ্জ্বলিত অসংখ্য তেলের প্রদীপের কোমল আলোয় সে দারা শুকোহ আর আওরঙ্গজেবকে ভালো করে দেখে, তাঁদের ইতস্তত দেখায়, হয়ত খানিকটা লাজুকও… কান্নার মাঝেই হাসির অভয় ফুটিয়ে সে তাঁদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়, আর তারা এবার তাঁর কাছে দৌড়ে ছুটে আসে।