‘বেশ, তাকে সেগুলো উপস্থাপন করতে বলেন। কি ধরনের পুরুষ মানুষ হলে তবে লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে নিজেকে সে মেয়েদের আঁচলের পেছনে লুকিয়ে রাখতে পারে? আমি কি পরামর্শদাতাদের সভায় অংশগ্রহণ করেছি? আমি কি তোমার সন্তানদের হাতকড়া পরাবার আদেশ দিয়েছি? তাদের প্রহরীদের জিজ্ঞেস করো–যদি তুমি তাদের খুঁজে পাও।
তার ছেলেরা তাকে কি বলেছে সেটা মনে করে, খুররম ভাবে, যুক্তিসঙ্গত কথা। বেশ শাহরিয়ার, এই অভিযোগের জবাব দাও।’
‘কিন্তু আমি জানি তিনি ঠিক এটাই চেয়েছিলেন… যে আমার কার্যকলাপ তাকে এবং লাডলীকে প্রীত করবে। আপনার অধপতন আর অপমান মেহেরুন্নিসাকে প্রহৃষ্ট করেছে। তিনি নিজে এর পেছনে ছিলেন, সবাই সেটা জানে।’
‘মেহেরুন্নিসা, এটা কি সত্যি?
‘বহু বছর যাবত আমি তোমার বন্ধু নই। আমি অবশ্যই সেটা স্বীকার করি। কিন্তু আমি ব্যক্তিগত শত্রুতা কিংবা সংকীর্ণ আক্রোশের বশবর্তী হয়ে কোনো কাজ করি। আমাদের সবার উচিত প্রথমে নিজের দিকে তাকানো। আমি আমার নিজের স্বার্থরক্ষায় কাজ করেছি… সেটা করতে গিয়ে আমি তোমার আর আরজুমান্দের স্বার্থহানির কারণ হয়েছি কিন্তু সেটা মূল উদ্দেশ্য ছিল না সেটা ছিল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। হ্যাঁ, আমি হয়তো তোমার অধিকাংশ দুর্ভোগের জন্য দায়ী এবং হ্যাঁ, আমি সেজন্য মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত… কিন্তু তোমার জানা উচিত যে তোমার সন্তানদের প্রতি আচরণের মাঝে সংকীর্ণ, বিদ্বেষপূর্ণ পরিশোধন করা আমার চরিত্রের সাথে মানানসই না।’
খুররম ভাবে, এটা নিশ্চিতভাবে সত্যি। দারা শুকোহ তাকে প্রাসাদ প্রাঙ্গণে বলেছে যে বন্ধুভাবাপন্ন প্রহরী তাকে বলেছিল যে শাহরিয়ার ব্যক্তিগতভাবে তাকে নির্দেশ দিয়েছে যে তাদের প্রকোষ্ঠে সরবরাহ করা খাবার যেন রাজকীয় রন্ধনশালা থেকে পাঠান না হয় কেবল চাপাতি আর পানি আর তাদের ডিভানের পরিবর্তে চারপায়া। তার মাঝে আবারও ক্রোধ পুঞ্জীভূত হতে শুরু করে যখন সে জানতে চায়, মেহেরুন্নিসা যা বলেছে সেটা কি সত্যি?’ শাহরিয়ার কোনো উত্তর দেয় না। তোমার মৃত্যুদণ্ডই প্রাপ্য, খুররম তাকে বলে, এবং তারপরে মেহেরুন্নিসার দিকে ঘুরে জানতে চায়, ‘কেন তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে না সেজন্য সাফাই হিসাবে আপনার কিছু বলার আছে?
মেহেরুন্নিসা নিজেকে ইস্পাতের ন্যায় কঠোর করে তুলে ঠিক যেমনটা সে করেছিল বহুবছর আগে জাহাঙ্গীরের সামনে তার নির্যাতিত, রক্তাক্ত, কুচক্রী ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে থাকার সময়। শাহরিয়ারের জন্য তার কিছুই করার নেই। তাঁর নিজেকে আর মেয়েকে এবং নাতনিকে বাঁচার একটা সুযোগ দিতে হলে শাহরিয়ারকে উৎসর্গ করা প্রয়োজন।
‘একজন মেয়ের পরামর্শের কি মূল্য আছে, তার কার্যকলাপ মৃত্যুদণ্ডের যোগ্য। তাকে বাঁচিয়ে রাখার অর্থই হল তোমার সিংহাসনের জন্য হুমকি হতে পারে এমন একজনকে বাঁচিয়ে রাখা। তোমার পূর্বপুরুষদের প্রদর্শিত উদারতার ফলে সৃষ্ট বিপদের কথা মনে রেখো। কামরান আর হুমায়ুন, খসরু আর তোমার আব্বাজানের কথা চিন্তা করো। বিদ্রোহী একবার ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করলে সে আবার সেটা চাইবে। তুমি, তোমার প্রিয়তমা আরজুমান্দ আর তোমার সন্তানেরা শাহরিয়ারের বিদায়ের ফলে নিরাপদে ঘুমাতে পারবে। তুমি নিজেও মনের গভীরে ভালো করেই সেটা জানো। তুমি শাহরিয়ারকে মৃত দেখতে চাও, এবং খসরুকেও। আমি সেটা দেখতে পাচ্ছি… প্রশ্ন হলো সেটা স্বীকার করার মত সাহস কি তোমার আছে? বেঁচে থাকার জন্য যা প্রয়োজন সেটা করতেই হবে। তোমার বিবেককে নতজানু করতে আমার শব্দগুলো ব্যবহার করতে পারো যদি তুমি এতই দুর্বল হও যে সেটা করা প্রয়োজন হয়। একজন নারী দোষের ভাগীদার হোক। কেন নয়?
খুররমের মাথার ভিতরে মেহেরুন্নিসার শব্দগুলো প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। হ্যাঁ, নিজের অন্তরে যদিও সে জানে তাঁর আব্বাজানের শূন্য সিংহাসন অধিকার করার জন্য সে তার সৎ-ভাইদের প্রতি ভিন্ন আচরণ প্রদর্শন করতো না, তারা যদি মারা যায় এবং তাদের হুমকি চিরতরে লোপ পায় তাহলে সে খুশিই হবে। আর হ্যাঁ, অন্যকারো উপরে সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব। চাপিয়ে দেয়ার মত আকাঙ্খ পোষন করার মত সে দুর্বলই বটে যাতে নিজের স্বার্থপরতার গভীরতার মুখোমুখি হবার তার কোনো প্রয়োজন হয়… কিন্তু সে যদি একজন সম্রাট হতে চায় তাহলে তাকে দায়িত্বের বোঝ নিতেই হবে। কিছু সময় পরে যে সময়টায় কেউই কোনো কথা বলে না, সে বলে, শাহরিয়ায়, এখন তোমার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে–এজন্য নয় যে তোমার অপরাধ এমনই গুরুতর বরং রাজবংশ, আমার আর আমার সন্তানদের খাতিরে। প্রহরী তাকে নিয়ে যাও। তরবারির আঘাতে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করবে। দ্রুত আর নিখুঁতভাবে এটা করবে।
শাহরিয়ার জ্ঞান হারিয়েছে বলে মনে হয় এবং প্রহরীরা নিচু হয়ে ঝুঁকে তাকে টেনে নিয়ে যেতে শুরু করে। প্রাঙ্গণের অর্ধেক অতিক্রম করার পরেই সে চিৎকার শুরু করে, তাদের মুঠোর মাঝে বেঁকে যায়, লাথি মারতে চেষ্টা করে। কোনো কারণে, হয়তো যা ঘটছে সেজন্য নিজের সংকল্প আর দায়িত্ব প্রদর্শনের জন্য, খুররম নিজেকে বাধ্য করে প্রহরীরা যতক্ষণ না তার সৎ-ভাইকে নিয়ে দৃষ্টির আড়ালে চলে যায় ততক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকতে। সে তারপরে মেহেরুন্নিসার দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। সে এখনও তাঁর দিকে শীতল আর অবজ্ঞার সাথে তাকিয়ে রয়েছে, চোখ সংহত আর ঠোঁটদ্বয় পরস্পরের শক্ত করে চেপে বসে আছে। কিন্তু সে যখন তাকে খুটিয়ে দেখে, খুররম অনুভব করতে শুরু করে যে তিনি একজন বৃদ্ধ মহিলা। তার চোখের নিচে ফোলা এবং তার কালো চোখের মণি কিনারার দিকে ধুসর হতে শুরু করেছে। তার উপরের ঠোঁট পাতলা ফিনফিনে চুলে আবৃত এবং তার মুখের চারপাশে বলিরেখা পরা আরম্ভ হয়েছে। তাঁর চোয়াল ঝুলতে শুরু করেছে। তিনি একজন বয়স্ক বিধবা যার কাছ থেকে তার রূপের মত ক্ষমতাও পুরোপুরি হ্রাস পেতে শুরু করেছে, তার যতই এখনও ঘটনাবলী প্রভাবিত করার আকাঙ্খ থাকুক। শাহরিয়ারের মত তিনি মৃত্যু ভয়ে ভীত নন। তাকে উপেক্ষা করাই হয়ত আরো বড় শাস্তি হবে। সে দেখুক কোনো কিছুর জন্য তাকে এখন কত কম গুরুত্ব দেয়া হয়।