‘সেটা হয়ত ভালোই হয়েছে। ভয় আর আতঙ্কে জর্জরিত অবস্থায় সে কি করে বসতো তার কোনো ঠিক নেই, খুররম বলে, মেহেরুন্নিসার পরিবর্তে তার সমস্ত ক্রোধ ক্রমশ শাহরিয়ারের উপরে পুঞ্জীভূত হতে থাকে। তিনি অন্তত তাঁর মুখোমুখি হবার সাহস দেখিয়েছেন এবং এটুকু বোঝার মত শুভবুদ্ধি তার অন্তত রয়েছে যে কখন তিনি পরাস্ত হয়েছেন এবং তাঁর সন্তানদের অবস্থান প্রকাশ করা। নিজেকে সন্তানদের আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করে, সে বলে, চলো তোমাদের উপরে সূর্যের আলোয় নিয়ে যাই। আমি শাহরিয়ারকে খুঁজে বের করার সময় তোমরা গোসল করে খাবার খাবে।
তাঁরা দ্রুত ভূ-গর্ভস্থ সেঁতসেঁতে কক্ষ ত্যাগ করে এবং সিঁড়ি দিয়ে উপরের আলোয় উঠে আসে, দুই ছেলেই বেশ কয়েকদিন অন্ধকারে থাকায় তারা সূর্যের দীপ্তি থেকে হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে রাখে।
তারা উপরে উঠে আসবার এক কি দুই মিনিট পরে, খুররম দেখে হেরেমের দিক থেকে একজন মহিলাকে রূঢ়ভাবে ধাক্কা দিয়ে প্রাঙ্গণের দিকে নিয়ে আসা হচ্ছে। তার প্রথম প্রতিক্রিয়া হয় কল্পনা করার চেষ্টা করা মেহেরুন্নিসা নিরবে নিজের পরাজয় মেনে নিয়ে তাঁর কাছে নিজেকে সমর্পণ করার সত্ত্বেও আবার নতুন করে কি নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়েছে। সে, অবশ্য, শীঘ্রই বুঝতে পারে এই রমণী মেহেরুন্নিসার চেয়ে লম্বা এবং তার কাঁধও বেশ চওড়া। প্রহরীরা তাকে খুররমের কাছে টেনে নেয়ার সময় সে তার গায়ের সব শক্তি দিয়ে বাঁধা দিতে চেষ্টা করছে, নিজের পা ফেলতে অস্বীকার করছে এবং প্রাণপনে ধ্বস্তাধ্বস্তি করছে। সে যখন আরেকটু কাছে আসে খুররম দেখে তাঁর চিবুকে খোঁচা খোঁচা দাড়ি রয়েছে যা এমনকি সবচেয়ে লোমশ মহিলার থাকার কথা নয়। মেয়েমানুষের পোষাক পরিহিত একজন পুরুষ–শাহরিয়ার, তার তার সুদর্শন মুখাবয়ব ডান চোখের চারপাশ ফুলে বেগুনী হয়ে উঠার কারণে, যা প্রায় বন্ধ হয়ে আছে, নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সে স্পষ্টতই সুবোধ বালকের মত ধরা দেয় নি।
‘তোমরা একে কোথায় খুঁজে পেয়েছো?’ শাহরিয়ারকে ধরে রাখা প্রহরীদের একজনকে খুররম জিজ্ঞেস করে, যে ইতিমধ্যে হাঁটু ভেঙে বসে পড়েছে এবং তাঁর দু’হাত অনুনয়ের ভঙ্গিতে পরস্পরকে আঁকড়ে রয়েছে।
‘আমরা সম্রাজ্ঞী মেহেরুন্নিসা, তার কন্যা লাডলী এবং লাডলীর সন্তানকে বন্দি করার পরে হেরেমে তল্লাশি শুরু করি। আমরা সেখানে এমন কাউকে দেখতে পাইনি যার সেখানে থাকার অধিকার নেই যতক্ষণ না আমরা সেখানের সর্বশেষ আর সবচেয়ে ছোট কক্ষের সামনে উপস্থিত হই। আমি ভেতরে প্রবেশ করি। কক্ষটায় ময়লা কাপড় আর অপরিষ্কার বিছানার চাদর পরিষ্কার করতে পাঠাবার আগে জমা করা হয়। প্রথমে সবকিছুই ঠিকঠাক আছে বলে মনে হয়, কিন্তু আমি যখন বের হয়ে আসবার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়েছি, দরজার কাছে ধোয়ার জন্য রাখা বিশাল একটা সাদা কাপড়ের স্তূপের ভেতরে একটা হাল্কা একটা নড়াচড়া আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে, এতই মৃদু যে ইঁদুর হওয়াও বিচিত্র না কিন্তু আমি ব্যাপারটা অনুসন্ধান করার সিদ্ধান্ত নেই। আমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ, আমি খুঁজে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমি কাপড়ের স্তূপে যখন লাথি মারি, আমার পা মাংসে আঘাত করে এবং একজন মহিলা লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায় এবং পালাতে চেষ্টা করে, সে পালিয়ে যাবার সময় আমার মুখে খামচে দিয়ে যায়। আমি পেছন থেকে তাঁর কাঁধ চেপে ধরি এবং তাকে কাপড়ের স্তূপের উপর চিৎ করে ফেলে দেই এবং সে যাতে পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য আমি তার দুপাশে দু’পা রেখে, হাঁটু ভেঙে বসে পড়ি। কে তুমি? কেন তুমি পালাতে চেষ্টা করছো?” আমি চিৎকার করে জানতে চাই। আমি ভেবেছিলাম তুমি আমায় ধর্ষণ করবে। আমি একজন কুমারী এবং তোমার মত একজন অভদ্র যোদ্ধার লালসার শিকার হবার কোনো ইচ্ছা আমার নেই,” সে বেশ উঁচু স্বরে বলে। আমি যদিও আগে কখনও কোনো মেয়ের এমন কর্কশ কণ্ঠস্বর শুনিনি, তারপরেও আমি তাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াতে শুরু করি কিন্তু আমি দাঁড়াতে গেলে সে হাঁটু দিয়ে আমার কুঁচকিতে আঘাত করে। আমি ব্যাথায় দু’ভাজ হয়ে কুঁকড়ে গেলে সে ধাক্কা দিয়ে আমায় একপাশে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করে কিন্তু আমি তাকে ধরে ফেলি। সে এরপরে আমার বাহু কামড়ে দেয়। সেই সময়েই তার নেকাব আলগা হয়ে যায় এবং আমি দেখি সে আসলে একজন পুরুষ এবং আমি তাকে জোরে ঘুষি মারি। সে এরপরে আর ধ্বস্তাধ্বস্তি করার চেষ্টা করে নি।
‘তুমি ভালো কাজ করেছো, খুররম বলে। শাহরিয়ারের দিকে তাকিয়ে সে এরপরে জানতে চায়, আর শাহরিয়ার, নিজের পক্ষে সাফাই দেয়ার জন্য তোমার কি বলার আছে?
আমায় মাফ করে দাও, তার সৎ-ভাই মিনতি করে, খুররমের দিকে সে সানুনয়ে তাকিয়ে রয়েছে।
তুমি আমার সন্তানদের সাথে যে আচরণ করেছে তারপরে কেন আমি তোমায় ক্ষমা করবো? তোমার এতবড় স্পর্ধা তুমি নির্দোষ যুবরাজদের সাথে সাধারণ অপরাধীদের মত আচরণ করেছো?”
‘আমি এসব করিনি। আমি কেবল
‘কেবল কি?
‘মেহেরুন্নিসার আদেশ অনুসরণ করেছি।’
‘দেখা যাক তাঁর এসম্বন্ধে কি বলার আছে। সম্রাজ্ঞীকে এখানে নিয়ে এসো, খুররম সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রহরীদের একজনকে আদেশ দেয়। তাকে কয়েক মিনিট পরে খুররমের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়, এখনও তাকে শান্ত আর সমাহিত দেখায়। এই কীট বলছে সে কেবল আপনার আদেশ পালন করেছে।’