‘তুমি নিশ্চয়ই আমার কাছে মিথ্যা বলছো না, বলছো কি?’ খুররম আশা আর ভয়ের মাঝে দোদুল্যমান অবস্থায়, চিৎকার করে জিজ্ঞেস করে। সবকিছুই কেমন বেশি সহজ মনে হচ্ছে। এটাও কি মেহেরুন্নিসার অনেক চালাকির একটা–কোনো ধরনের ফাঁদ?
‘আমি কেন মিথ্যা বলতে যাব? সবকিছু শেষ হয়ে গিয়েছে। তুমিই চূড়ান্ত বিজয়ী। তোমার ক্রোধের কারণ হয়ে আমি সম্ভাব্য কি সুবিধা লাভ করতে পারবো? তুমি এখন আগে তাঁদের কাছে যাও।’
‘এই রমণীকে হেরেমে আটকে রাখো। আমি পরে তার ভাগ্য নির্ধারণ করবো, খুররম সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নিচে নেমে তোরণগৃহের নিচে দিয়ে বের হয়ে সূর্যালোকিত প্রাঙ্গণে যাবার আগে তাঁর লোকদের আদেশ দেয়। সে শাহরিয়ারের কিছু সৈন্যকে সেখানে হাত পিছমোড়া অবস্থায় আসনসিঁড়ি করে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে থাকতে দেখে যখন তাঁর লোকেরা অন্যদের খুঁজছে আর ধৃত অস্ত্র জমা করছে।
হা, পশ্চিম প্রান্তে একটা বৃত্তাকার গম্বুজ রয়েছে এবং, হ্যাঁ, সেখানে মনে হচ্ছে মাটির নিচে ভূ-গর্ভের দিকে একপ্রস্থ সিঁড়ি নেমে গিয়েছে। খুররম সেদিকে দৌড়ে যায় এবং একবারে দুটো করে ধাপ টপকে নিচে নামতে শুরু করে, কিন্তু শেওলা-আবৃত নিচের একটা ধাপে তার পা পিছলে যায় এবং সে আবারও গোড়ালি মচকায়। নিজেকে গড়িয়ে পড়ার হাত থেকে কোনোমতে রক্ষা করে, সে চারপাশে তাকিয়ে একটা নিচু খিলানের পেছনে সেঁতসেঁতে, ছাতার গন্ধযুক্ত, অন্ধকার গলি দেখতে পায়। সে খোঁড়াতে খোঁড়াতে নিজের দেহরক্ষীদের নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। সেটা একটা কানা-গলি কিন্তু দেখা যায় দুপাশে একটা করে দরজা রয়েছে। প্রতিটা দরজার উপরিভাগ কেটে লোহার ছোট গরাদ বসানো হয়েছে এবং দুটো দরজাই লোহার শেকল দিয়ে আটকানো।
‘দারা আর আওরঙ্গজেব, খুররম চিৎকার করে উঠে, “তোমরা কি ভিতরে আছো?’
কোনো উত্তর শোনা যায় না। সবচেয়ে খারাপ সম্ভাবনার কথা চিন্তা করে সে ডান দিকের দরজার উপরের লোহার গরাদের ভিতর দিয়ে উঁকি দেয়। আওরঙ্গজের গরীব গ্রামবাসীর গৃহে যেমন পাওয়া যায় সেরকম দড়ির একটা চারপায়ায় শুয়ে রয়েছে, একটা নোংরা খয়েরী কাপড় তার মুখে গোঁজা আর তার দু’হাত দেয়ালের সাথে শিকল দিয়ে আটকানো। চারপায়ার নিচে মল-মূত্রে কানায় কানায় ভরা একটা পিতলের পাত্রের পাশেই মাটির বাসনে আধ-খাওয়া একটা চাপাতি পড়ে রয়েছে। খুররম অন্য গরাদের ভিতর উঁকি দেয়ার সময় নিজের সন্তানকে জীবিত দেখার স্বস্তির সঙ্গে তাঁদের সাথে কেউ এমন আচরণ করতে পারে দেখে সৃষ্ট ক্রোধ মিশে যেতে থাকে এবং দেখে দারা শুকোহ একইভাবে মুখ আর হাত বাধা অবস্থায় সেখানে রয়েছে।
দরজাগুলো ভেঙে ফেলো, সে চিৎকার করে তার সাথের দেহরক্ষীদের আদেশ দেয়। একজন–স্থূলদেহী রাজপুত–দুটো দরজাই পর্যায়ক্রমে গায়ের পুরো শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিতে শুরু করে কিন্তু খুব একটা লাভ হয় না। অন্য আরেকজন তারপরে একটা লম্বা লোহার দণ্ড খুঁজে বের করে এবং দারা শুকোহর দরজার শিকলের ভেতর সেটা প্রবিষ্ট করায় এবং প্রবল একটা গর্জনের সাথে তীব্র মোচড় দিয়ে শিকলের একটা আংটা খুলে ফেলে। দরজা খোলা মাত্র খুররম তাঁর সামনের লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে একপাশে সরিয়ে পূতিগন্ধময় কামরার ভেতরে প্রবেশ করে। সে কাঁপা কাঁপা আঙুলে দ্রুত তার মুখের বাঁধন খুলতে শুরু করে যখন অন্য দেহরক্ষীরা হাতের শিকল ভেঙে ফেলে। দারা শুকোহ, তুমি এখন নিরাপদ, সে, প্রাণপণে কান্না চেপে রাখার চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত যখন মুখের বাঁধন খুলতে সফল হয়, বলে। দারা শুকোহ, একই সময়, তাঁর হাতের বাধন খুলে যেতে-আবেগে তাঁর পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে–দু’হাতে তার আব্বাজানের গলা জড়িয়ে ধরে। আওরঙ্গজেবকে অন্য দেহরক্ষীরা কিছুক্ষণ পরে মুক্ত করতে সক্ষম হলে সে দৌড়ে ভাইয়ের প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করে এবং দু’জনকেই জড়িয়ে ধরে। খুররম স্বস্তি এবং আনন্দের অশ্রু আর চেপে রাখতে পারে না। কিন্তু বর্ণনার সাথে তাদের এই আপাত সাদৃশ্যের মাঝেও সে লক্ষ্য করে যে তাঁদের চোখ কোটরাগত এবং তাদের যেমন স্বাস্থ্য হওয়া উচিত তারা তারচেয়ে কৃশকায়।
কয়েক মিনিট পরে যে সময়টা তারা কেউই কোনো কথা বলতে পারে না খুররম জানতে চায়, তোমাদের কতদিন এভাবে বন্দি করে রাখা হয়েছে? ‘আব্বাজান, চৌদ্দদিন, দারা শুকোহ বলে, তার কণ্ঠস্বর মুখে কাপড় গোঁজা থাকার কারণে এখনও রুক্ষ আর কর্কশ।
‘আমাদের তখন থেকেই একহাত দেয়ালে বাধা অবস্থায় এসব প্রকোষ্ঠে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। কয়েক ঘন্টা আগে আমাদের দু’হাত বেধে মুখে কাপড় গোঁজা হয়েছে, আওরঙ্গজেব খুলে বলে।
‘তোমাদের বন্দি করার আদেশ কে দিয়েছিল?
‘আমাদের প্রথম যখন এখানে নিয়ে আসা হয় তখন প্রহরীদের একজন আমায় বলেছিল শাহরিয়ারের আদেশে, দারা শুকোহ বলে। প্রহরীটা আমার সাথে ভালো আচরণ করতো আর হাতকড়া পরাবার আগে কব্জিতে নরম কাপড় জড়িয়ে দিতে। তাঁর প্রতি অনুগ্রহ করে সদয় আচরণ করবেন।’
‘আমি দেখবো তাকে যেন কঠোর শাস্তি দেয়া না হয়। সে কি তোমায় বলেছিল যে শাহরিয়ার তোমায় কেন বন্দি করছে?
‘আমরা যাতে পালিয়ে যেতে না পারি অথবা আমাদের কেউ উদ্ধার করতে না পারে যাতে সে আমাদের জিম্মি হিসাবে ব্যবহার করতে পারে,’ দারা শুকোহ বলে এবং তারপরে এক মুহূর্ত পরে বলে, ‘আব্বাজান, আমার মনে হয় শাহরিয়ার কিছুক্ষণ আগে আমাদের নিয়ে যাবার জন্য এখানে এসেছিল। দরজার শিকল ধরে কেউ এমনভাবে নাড়াচাড়া করছিল যেন শিকল খুলতে চেষ্টা করছে এবং আমার মনে হয় প্রহরীদের উদ্দেশ্যে আমি একটা কণ্ঠস্বরকে জিকার করতে শুনেছি। কিন্তু তারা কেউ আসে নি এবং সেও দরজা খোলার কোনো উপায় খুঁজে পায় নি।