*
মেহেরুন্নিসা প্রাসাদের দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত নিজের আবাসন কক্ষের গবাক্ষ থেকে সরে দাঁড়ায় এবং শুক্তির রঙিন খোলা দিয়ে নক্সা করা বাটের গাদাবন্দুকটা নামিয়ে রাখে যা দিয়ে সে প্রচুর বাঘ শিকার করেছে। তার নিশানা এত দূর থেকেও লক্ষ্যভেদ করেছে। খুররমের সামনে দেহরক্ষীটা এভাবে কেন এগিয়ে এলো? সে তাকে দেখতে পেয়ে যুবরাজকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছে এটা অসম্ভব। তার মন তারপরে এখন যখন প্রাসাদের পতন হয়েছে যা প্রতি মুহূর্তে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে আবার বরাবরের মত সক্রিয় হয়ে উঠে নিজেকে রক্ষা করার উপায় নিয়ে ভাবতে শুরু করে। খুররম আর তার লোকেরা শীঘ্রই তন্নতন্ন করে প্রাসাদে তল্লাশি চালান শুরু করবে তার সন্তানকে, তাকে এবং শাহরিয়ারকে খুঁজতে।
শাহরিয়ার কোথায়? সে ব্যক্তিগতভাবে সৈন্য পরিচালনা করে নি, বা সে লাডলির সাথেও নেই যে তাঁর সন্তানদের নিয়ে পাশের কক্ষে অবস্থান করছে সে জানে। তাদের কারো উপরে তাঁর পক্ষে নির্ভর করা সম্ভব না বরং তাকে অতীতের মত আবারও নিজের বুদ্ধির উপরেই নির্ভর করতে হবে। সে ভালো করেই জানে যে তাঁর গাদাবন্দুকের গুলিটা অনেক অর্থেই একটা দূরপাতী গুলি ছিল। সে যদি এমনকি খুররমকে হত্যা করতে সক্ষমও হতো তাহলেও বোধহয় তাঁর লোকেরা আত্মসমর্পণ করতো না। তারা বরং–আরজুমান্দ আর তার ভাই আসফ খানের তাড়াহুড়োর কারণে–দারা শুকোহকে সম্রাট হিসাবে ঘোষণা করতো। তার তাহলে কি, নিজের গাদাবন্দুকটায় গুলি ভরা এবং তাঁর আবাসন কক্ষের দরজা দিয়ে তাঁরা ভেতরে প্রবেশ করতে শুরু করলে প্রথমজনকে হত্যা করে, লড়াই করেই মৃত্যুবরণ করা উচিত? না। সে তার জন্মের পর থেকে অসংখ্যবার বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েও বেঁচে রয়েছে। সে এখনও মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত নয়। একটা শান্ত, সমাহিত আর তীক্ষ্ণধী মন মারাত্মক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে আর সেটাকে স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারে। অসহায় নারী’ হিসাবে তাঁর অবস্থান একবারের জন্য হলেও তাকে সাহায্য করবে। সে জানে তাঁর কি করা উচিত…
*
খুররম তাঁর কয়েকজন দেহরক্ষীকে নিয়ে প্রাসাদের দ্বিতীয় তলার দিকে নেমে যাওয়া সাদা মার্বেলের দুই প্রস্থ সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নিচে নামতে শুরু করে যেখানে, তোরণগৃহের হট্টগোলের ভিতরে কিছুক্ষণ চিন্তা করার পরে তাঁর মনে পড়েছে রাজকীয় আবাসন কক্ষগুলো অবস্থিত। সে নিজের সন্তানদের খোঁজে একটামাত্র গবাক্ষ দ্বারা আলোকিত একটা স্থাপক পথের দু’পাশে অবস্থিত হাতির দাঁতের কারুকাজ করা দরজা একটার পর একটা খুলে দেখতে থাকে। তারা কোথায়? মেহেরুন্নিসা আর শাহরিয়ার কি নিজেদের নিরাপদ অতিক্রমণ নিশ্চিত করতে তাদের জিম্মি হিসাবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে গোপনে সরিয়ে ফেলেছে। নাকি তারচেয়েও জঘন্য, তাঁর সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে তাঁদের তাঁরা হত্যাই করেছে? সে ভাবে, মেহেরুন্নিসার কারণে সে সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দিতে পারে না, নিজের অজান্তেই তার হাত তরবারির বাট আঁকড়ে ধরে।
সে প্রথম যে কক্ষটায় প্রবেশ করে সেটা পুরোপুরি ফাঁকা এবং জানালা দিয়ে প্রবাহিত হওয়া বাতাসে কেবল মাত্র মসলিনের পদাই আন্দোলিত হচ্ছে। দ্বিতীয় কক্ষটাও শূন্য এবং তৃতীয়টাও যদিও উপুড় হয়ে থাকা একটা রূপার পানপাত্র আর মাটিতে গড়িয়ে পড় শরবত দেখে বোঝা যায় যে কক্ষের বাসিন্দা একটু আগেই তাড়াহুড়ো করে জায়গাটা ত্যাগ করেছে। সে কক্ষটা থেকে তরবারি হাতে বের হয়ে আসতে স্থাপন পথ বরাবর দূরে অবস্থিত একটা দরজা খুলে যায় এবং ভেতর থেকে পিঠ সোজা করে কালো কাপড়ে আবৃত একটা নারী মূর্তি বের হয়ে আসে একটা মাখন রঙের শাল দিয়ে তাঁর মুখ ঢাকা। অবগুণ্ঠিত রমণী মাথা উঁচু করে তার দিকে স্থির পদক্ষেপে এগিয়ে আসতে শুরু করে। খুররম প্রায় সাথে সাথে অবয়বটা অঙ্গস্থিতি আর সৌশাম্য দেখে বুঝতে পারে যে সেটা স্বয়ং মেহেরুন্নিসা। সে তাকে আটকাবার আদেশ দেয়ার আগেই সে তাঁর শাল ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তার কাছ থেকে বারো ফিট দূরে মেঝের উপর নিজেকে নিক্ষেপ করে।
‘খুররম, আমি আত্মসমর্পণ করছি। কাঙ্খিত সিংহাসন এখন কেবল তোমার। তোমার যা ইচ্ছা আমার সাথে করতে পারো,’ সে বলে কিন্তু তারপরে যোগ করে, কিন্তু তার আগে তুমি নিশ্চয়ই জানতে চাইবে দারা শুকোহ আর আওরঙ্গজেব কোথায় আছে?
খুররম অপলক তাকিয়ে থাকে। মেহেরুন্নিসা কি তাঁর একমাত্র সম্ভাব্য দরকষাকষির অনুষঙ্গ তাঁর সন্তানদের নিজের জন্য কোনো ধরনের ছাড় না চেয়েই সমর্পণ করবেন?
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। তারা কোথায় আছে?
‘প্রাসাদের পূর্বভাগে বৃত্তাকার বেলেপাথরের গম্বুজের ভূগর্ভে অবস্থিত দুটো ছোট কক্ষে শাহরিয়ার তাদের বন্দি করে রেখেছে। তারা চব্বিশ ঘন্টা প্রহরাধীন অবস্থায় রয়েছে, যদিও শাহরিয়ার আর তার লোকেরা সাহসের যে নমুনা দেখিয়েছে সেটা বিবেচনা করে বলা যায় প্রহরীরা নিজেদের জান বাঁচাতে এই মুহূর্তে নাক বরাবর ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে পালাচ্ছে। দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। তোমার সন্তানেরা সুস্থ আছে, যদিও আলো বাতাসের অভাব আর বন্দি থাকার কারণে খানিকটা ফ্যাকাসে আর রোগা হয়ে গিয়েছে।’