দুই মিনিট পরে সে যখন পুনরায় একটা নিম গাছের কাণ্ডের পেছনে ঘামে জবজবে অবস্থায় দম নেয়ার জন্য থামে যা কামানের গোলার আঘাতে ভূপাতিত হয়েছে, সে ততক্ষণে আরো ছয়শ গজের মত দূরত্ব অতিক্রম করেছে, গাদাবন্দুকের গুলি আর তীরের ঝাঁক শিস তুলে তার পাশ দিয়ে অতিক্রম করে। সে তার বামগালে যাকে ঘামের একটা ধারা বলে মনে করেছিল সেটাকে সে তার গলায় ঝোলান মাখন রঙের বড় রুমাল দিয়ে মুছতে গিয়ে কাপড়ে রক্তের দাগ দেখতে পায়। সে হাতের দাস্তানা খুলে মুখে আঙুল দিয়ে খুঁজে দেখতে গিয়ে বাম কানের পাশে একটা ক্ষত আবিষ্কার করে, যা অবশ্য সামান্য ছড়ে যাবার ক্ষত, সম্ভবত কামানের কিংবা বন্দুকের গুলির কারণে ছিটকে আসা উড়ন্ত ইটের টুকরোয় সৃষ্টি। গাছের গুঁড়ির পাশ দিয়ে উঁকি দিয়ে সে দেখে যে নিরাপত্তা বেষ্টনী পর্যন্ত বাকি পথটায় তেমন আর কোনো আড়াল নেই যা প্রায় চারফিট উঁচু কিন্তু রাভি নদীর ওপাড় থেকে আসফ খানের কামানের গোলায় যার অনেকস্থানই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে দেখা যায়।
খুররম তার চারপাশে সমবেত লোকদের দম ফিরে পাবার জন্য কয়েক মিনিট সময় দিয়ে তূর্যবাদকদের চিৎকার করে আদেশ দেয় আসফ খানকে পূর্ব নির্ধারিত সংকেত পাঠাতে যে তারা এবার নিরাপত্তা প্রাচীর আক্রমণ করবে আর তাই তাঁর কামানগুলোকে সেখানে গোলাবর্ষণ করা থেকে বিরত রাখতে। সে এরপরে নিশানাবাহকদের তাদের বিশাল সবুজ ঝাণ্ডা উঁচু করার আদেশ দেয়। সে এরপরে উঠে দাঁড়ায় এবং দেহরক্ষী পরিবেষ্টিত অবস্থায় মাথা নিচু করে নিরাপত্তা প্রাচীর লক্ষ্য করে আরো একবার দৌড়াতে শুরু করে। গাদাবন্দুকের গুলি আবারও তার পাশ দিয়ে বাতাসে শিস তুলে ছুটে যায় এবং একটা তীর তার বুকের বর্মে প্রতিহত হয়ে ছিটকে যায়। সে এর এক মুহূর্ত পরেই নদীর পাড়ে প্রায় অদৃশ্য একটা ইঁটের টুকরোয় হোঁচট খায় এবং প্রায় হাত-পা ছড়িয়ে মাটিতে ছিটকে পড়ে। নিজেকে দ্রুত সামলে নিয়ে সে প্রায় সাথে সাথেই এরপর নিরাপত্তা প্রাচীরের কাছে পৌঁছে যায়। নিজের পেষল হাতের সাহায্যে দেহের পুরো ভর তুলে সে প্রাচীরের উপর দু’পা ফাঁক করে উঠে বসে এবং লাফিয়ে অন্যপাশে নেমে আসে। সে পায়ের উপর আলতো ভর দিয়ে লাফিয়ে নিচে নামার প্রায় সাথে সাথে দীর্ঘদেহী এক তবকির আক্রমণের মুখে পড়ে। গাদাবন্দুকটায় গুলি না থাকায় সে সেটাকে উল্টো করে ধরে এবং খুররমকে লক্ষ্য করে নলটা দিয়ে লাঠির মত তাকে আঘাত করতে চেষ্টা করে যে গোড়ালীর উপর ভর দিয়ে পেছনের দিকে ঝুঁকে গিয়ে আঘাতটা এড়ায় আর সেই সাথে নিজের তরবারি ঢ্যাঙা লোকটার বিশাল পেটের গভীরে ঢুকিয়ে দেয়। সে তার রক্তাক্ত অস্ত্র লোকটার দেহ থেকে হ্যাঁচকা টানে বের করে আনতে ক্ষতস্থান থেকে সশব্দে বায়ু নির্গত হয়। খুররম তারপরে তাকে আক্রমণের উদ্দেশ্যে আরেকজনকে নিজের বাকান তরবারি মাথার উপর উত্তোলিত করতে দেখে। খুররম আবার পেছনে সরে যাবার চেষ্টা করার সময় পিছলে গিয়ে নিজের গোড়ালী মচকায় এবং একপাশে কাত হয়ে পড়ে যায়। সে মাটিতে পড়লে প্রতিপক্ষ তাঁর সামনে আবির্ভূত হয়ে আঘাত করার প্রস্তুতি নিতে সে মাটি স্পর্শ করার সাথে সাথে গড়িয়ে একপাশে সরে যায়। লোকটা তরবারি তার মাথার পাশের মাটিতে গেঁথে যায়। খুররম তাঁর নিজের তরবারি দিয়ে লোকটা পায়ে আঘাত করে এবং লোকটাও এবার ভূপাতিত হয়। খুররম আপ্রাণ চেষ্টা করে দ্রুত হাঁটুর উপর ভর দিয়ে বসে প্রতিপক্ষ মাটিতে পড়ে থাকায় তরবারিটা গলা লক্ষ্য করে তাঁর পক্ষে যত জোরে সম্ভব নামিয়ে আনে। রক্ত কিছুক্ষণ গলগল করে বের হতে থাকে তারপরে লোকটা চিরতরে নিথর হয়ে যায়।
খুররম হাচড়পাঁচড় করে নিজের পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায় এবং নিজের চারপাশে তাকালে, সে দেখে যে নিরাপত্তা প্রাচীর এখন তার লোকদের দখলে এবং সর্বত্র তাদের প্রতিপক্ষ লড়াই ছেড়ে পালাতে শুরু করেছে এবং প্রাণপণে প্রাসাদের নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে ছুটে যাচ্ছে। সে এরপরে নিজের সামনে থোয়ার ভিতর দিয়ে মোগলদের সবুজ নিশান আবির্ভূত হতে দেখে। মহবত খানের রাজপুত যোদ্ধারা অন্যপাশ দিয়ে নিরাপত্তা প্রাচীর ভেঙে ফেলেছে। প্রাসাদের মূল তোরণদ্বার আক্রমণ করো, খুররম চিৎকার করে বলে, উত্তেজনা আর ধোয়ায় তাঁর কণ্ঠস্বর কর্কশ শোনায়, এবং নিজের লোকদের সাথে নিয়ে সে মচকানো গোড়ালীর ব্যাথা সহ্য করে যতটা দ্রুত সম্ভব সামনের দিকে দৌড়াতে শুরু করে, পুরোটা সময় তবকি অথবা তীরন্দাজদের আক্রমণের সামনে পড়ার আশঙ্কা করতে থাকে। তাকে অবাক করে দিয়ে অবশ্য কোনো তীর অথবা সীসার গুলি ধেয়ে আসে না। শাহরিয়ারের বাহিনী যেন শূন্যে মিলিয়ে গিয়েছে। তারা কি যুদ্ধ করার মনোবল হারিয়ে ফেলেছে নাকি তারা পূর্বনির্ধারিত কোনো পরিকল্পনা অনুযায় ভেতরের কোনো শক্তঘাঁটি অভিমুখে বা অতর্কিত হামলার জন্য নির্ধারিত স্থানে পশ্চাদপসারণ করছে?
খুররম দৌড়াবার সময় মাটিতে পরিত্যক্ত অবস্থায় অসংখ্য গাদাবন্দুক আর তরবারি পড়ে থাকতে দেখে। সে উল্টে রাখা শকট আর অন্যান্য প্রতিরক্ষা অবস্থান পাশ কাটিয়ে যায়, যার কোনোটা কামান সজ্জিত যেখান থেকে তোপচি আর সেই সাথে তবকিরা মারাত্মক ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি করতে পারতো, কিন্তু একটা গোলা বর্ষণ না করেই যা পরিত্যক্ত হয়েছে। শাহরিয়ারের লোকেরা আসলেই পালাতে শুরু করেছে। খুররম শীঘ্রই প্রাসাদের উঁচু, ধাতব কীলক সজ্জিত কাঠের দরজার দিকে এগিয়ে যায় যা এখন খোলা এবং আপাতদৃষ্টিতে অরক্ষিত। সে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ভাবে, তাঁর বিজয় হয়েছে। নিজের সন্তানদের এখন তাকে খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু সহসা তাঁর পাশে দৌড়াতে থাকা দেহরক্ষী একটা পাথরের টুকরো এড়াবার জন্য দিক পরিবর্তন করে তাঁর সামনে চলে আসে এবং পরমুহূর্তেই হাত পা ছড়িয়ে সামনের মাটিতে পড়ে থাকে। লোকটার দেহ এড়িয়ে যাবার জন্য ঘুরে যাবার সময় খুররম নিচের তাকিয়ে দেখে লোকটা ঠিক কপালের মাঝখানে গুলি বিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু সে এটা নিয়ে আর কিছু ভাববার অবকাশ পায় না তার আগেই সে তোরণগৃহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে।