ধাবমান দলটার একেবারে পেছনের অশ্বারোহী, উপরের দিকে হাত ছুঁড়ে এবং পর্যাণ থেকে সামনের দিকে ছিটকে পড়ে, সম্ভবত গাদাবন্দুকের গুলির আঘাতে। আরেকটা ঘোড়া–খয়েরী রঙের–পিঠের আরোহীকে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে মাটিতে আঁছড়ে পড়ে, কিন্তু বাকিরা করকটে গাছের ঝাড়ের পেছনে অক্ষত অবস্থায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। খুররম জানে যে মেহেরুন্নিসা যদি ইতিমধ্যে না জেনে থাকে কিন্তু সে অচিরেই সতর্ক হয়ে যাবে যে খুররম আর তার লোকেরা নদী অতিক্রম করেছে। জলদি, সে তার একজন সেনাপতিকে তাড়া দেয়। দূরবর্তী তীরের দিকে নৌকা সেতুর অংশটা টেনে নিয়ে যাওয়া শুরু করো। আমাদের বাহিনীকে নদী পার হবার জন্য প্রস্তুত হতে বলল। সময় নষ্ট করা যাবে না।
*
দুই ঘন্টা পরে, খুররম নদীর দূরবর্তী তীরে অবস্থান করে। তাঁর লোকেরা দ্রুত নৌকা সেতু নির্মাণ সম্পন্ন করেছে। সেতুর অংশ বিশেষ যদিও এর সাথে শক্ত শনের দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা ছোট নৌকায় অবস্থানরত মাঝিরা স্রোতের উল্টো দিকে দাঁড় টেনে সুস্থির রেখেছে, সেতুটা তৈরির উদ্দেশ্যে সার্থক হয়েছে। সেতুটা যদি এখন ছিঁড়েও যায়, তার অধিকাংশ অশ্বারোহী, অনেকগুলো রণহস্তী আর এমনকি তার ছোট কামানের বেশ কয়েকটা ইতিমধ্যেই নদী অতিক্রম করেছে–লাহোর প্রাসাদের চারপাশের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় হামলা শুরু করার জন্য পর্যাপ্ত।
খুররম তার সেনাপতিদের নিজের চারপাশে জড়ো করে, সবাই তারই মত যুদ্ধের জন্য মুখিয়ে রয়েছে, সে তাঁদের উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত একটা বক্তৃতা দেয়। এটা জেনে রাখো। আজকের দিন আমার জীবনের সবচেয়ে সঙ্কটপূর্ণ দিন। আজকের দিনাবসানে আমি তোমাদের সহায়তায় রাজকীয় সিংহাসনে অধিকার নিশ্চিত করবো এবং আমার প্রিয় সন্তানদের উদ্ধার করবো অথবা এই প্রয়াস বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আমি মৃত্যুবরণ করবো। কিন্তু আমি জানি যে তোমাদের সহায়তায় আমি সফল হবই। আমি যখন সফল হব, লাহোরের কোষাগার থেকে তোমাদের প্রত্যেককে আমি চোখ ধাঁধানো উপহার প্রদান করবো এবং সেইসাথে অন্যায়ভাবে ক্ষমতা দখলকারী আমার সৎ-ভাইয়ের সমর্থকদের জমি বাজেয়াপ্ত করে আমি তোমাদের মাঝে বণ্টন করবো।
মনে রাখবে, আমাদের পরিকল্পনা কিন্তু একেবারে সহজ সরল। আমরা যেই মাত্র আসফ খানের নেতৃত্বে রাভি নদীর ওপারে প্রাসাদের নিরাপত্তা বেষ্টনী লক্ষ্য করে কামানের গোলাবর্ষণের শব্দ শুনতে পাব, আমরা আর মহবত খানের লোকেরা বার্তাবাহক আমায় জানিয়েছে তিনি উজান দিয়ে নিরাপদেই নদী অতিক্রম করেছেন যুগপৎ বিপরীত দিক থেকে নিরাপত্তা বেষ্টনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়বো।’
খুররম কয়েক মিনিট পরেই আসফ খানের কামানের গোলাবর্ষণের গমগম শব্দ শুনতে পায়। পুরোভাগে তাঁর চারজন দেহরক্ষী নিয়ে সবাই গাঢ় সবুজ রঙের বিশালাকৃতি নিশান বহন করছে এবং পিতলের লম্বা বাদ্যযন্ত্রে গগনবিদারী আওয়াজ সৃষ্টিকারী চারজন তূর্যবাদক নিয়ে, সে তার লোকদের একেবারে সামনে অবস্থান করে তার কালো ঘোড়ার পাজরে গুঁতো দেয় সামনে এগিয়ে যেতে। সে শীঘ্রই নদীতীরের জমাট বাঁধা অনাবৃত কাদার উপর দিয়ে আস্কন্দিত বেগে ঘোড়া ছোটাতে থাকে। সে যখন যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে যায় তার হৃৎপিণ্ড স্বাভাবিকের চেয়েও জোরে স্পন্দিত হতে থাকে এবং আসন্ন লড়াইয়ে পুরোপুরি মনোসংযোগ করতে তাঁর রীতিমত কষ্ট হয়। সে কেবলই মনে মনে চিন্তা করতে থাকে প্রাসাদের কোথায় সে তাঁর সন্তানদের খুঁজে পাবে যদি সাফল্যের সাথে সে প্রাসাদের ভেতরে প্রবেশ করতে পারে।
সে খুব ভালো করেই জানে যে তাকে বর্তমান পরিস্থিতির উপরে মনোনিবেশ করতে হবে এবং সে যদি নিজের সন্তানদের রক্ষা করা আর নিজেকে এবং নিজের লোকদের নিরাপত্তার লক্ষ্য অর্জন করতে চায় তাহলে তাকে সামনে এগিয়ে গেলে চলবে না, সে নিজের ঘোড়ার লাগাম একটু টেনে ধরে। সে তারপরে আসফ খান আর শাহরিয়ারের তোপচিদের মাঝে কামানের গোলা বিনিময়ের ফলে সৃষ্ট কুণ্ডলীকৃত ধোয়ার মেঘের মাঝে উঁকি দিয়ে দেখতে চেষ্টা করে। নিরাপত্তা প্রাচীরের ভিতরে অবস্থিত প্রাসাদ সামনে আর মাত্র মাইল দূরে রয়েছে। শাহরিয়ারের লোকেরা অবশ্য মনে হয় যেন নিরাপত্তা প্রাচীর আর তার বর্তমান অবস্থানের ভিতরের সব ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে গোলাবর্ষণের জন্য নিজেদের একটা পরিষ্কার মাঠের সুবিধা দিতে। গুঁড়িয়ে দেয়া বাড়িঘরের জমে থাকা ভাঙা টুকরো যা পরিষ্কার করা হয় নি তাঁর অশ্বারোহীদের গতি শ্লথ করে দেয়, এবং সে হতাশ হয়ে ভাবে যে নিরাপত্তা ব্যবস্থার কাছাকাছি পৌঁছাবার আগে তাঁদের অনেকেই পৃথিবী থেকে নিঃশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তারা যদি ঘোড়া থেকে নেমে শেষ আটশ গজ পায়ে হেঁটে এগিয়ে যায় তাহলে জমে থাকা ভাঙা ইটের স্তূপ তাদের আঁড়াল দিবে।
সে নিজের ঘোড়াকে বৃত্তাকারে ঘুরিয়ে নিয়ে তাঁর লোকদের অগ্রগামী দলটাকে ঘোড়া থেকে নামার আদেশ দেয়। প্রতি ছয়জনে একজন লোককে ঘোড়াগুলোকে দড়ি দিয়ে বাঁধার জন্য পেছনে রেখে সে অবশিষ্ট লোকদের নেতৃত্ব দিয়ে একটা ধ্বংস স্তূপ থেকে আরেকটার দিকে এগোতে থাকার সময় কোমরের কাছ থেকে সামনের দিকে বেঁকে থাকে। তার পুরো দূরত্বে দশ ভাগের এক ভাগও অতিক্রম করার আগেই শাহরিয়ারের তাঁদের দেখতে পায় এবং তাদের কামান আর গাদাবন্দুকের নিশানায় পরিণত করে। খুররম একটা দেয়ালের অবশিষ্টাংশের পেছনে নিজেকে নিক্ষেপ করে। সে সেখানে আড়াল নেয়ার মাঝে সে দেখে ভাঙা ইটের একটা স্তূপের পেছনে লুকিয়ে থাকা তার একজন যোদ্ধা হঠাৎ ধপ করে বসে পড়ে, সম্ভবত প্রতিহত হওয়া কোনো গুলি আঘাত করেছে যেহেতু তাঁর সামনের দিক ভালোমতই সুরক্ষিত। তারপরে, নিজের দাস্তানা পরিহিত হাত আন্দোলিত করে নিজের লোকদের তাকে অনুসরণ করার ইঙ্গিত দিয়ে, যা তাঁরা সাহসিকতার সাথে করে, খুররম উঠে দাঁড়ায় এবং পুনরায় সামনের দিকে দৌড়াতে শুরু করে, আঘাত এড়াবার জন্য একটা ধ্বংসস্তূপ থেকে আরেকটার দিকে দিকে এগিয়ে যাবার সময় প্রতিপক্ষের নিশানা লক্ষ্যভ্রষ্ট করতে সে খানিকটা এঁকেবেঁকে দৌড়ায়।