‘আমি এখন তোমাকে বাংলায় যাবার এবং ফিরে আসবার খরচ হিসাবে পাঁচশ সোনার মোহর দেবো। শের আফগান যখন মারা যাবে তখন আমি তোমাকে আরও এক হাজার মোহর দেবো।’
বার্থোলোমিউ হকিন্স মাথা নাড়ে। তার চওড়া মুখে, সূর্যের খরতাপে লাল, সন্তুষ্টির অভিব্যক্তি। লোকটা যদিও প্রায় দশ ফিট দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে জাহাঙ্গীর তার গায়ের প্রায় পশুর মত তীব্র দুর্গন্ধ তারপরেও টের পায়। এই ফিরিঙ্গিগুলো গোসল করে না কেন? আগ্রায় তাঁর দরবারে ক্রমশ আরো বেশি সংখ্যায় তাদের আগমন ঘটছে। এই লোকটার মত ইংরেজ, ফরাসী, পর্তুগীজ, এবং স্পেনীশ এবং ধর্মপ্রচারক, ব্যবসায়ী বা ভাড়াটে সৈন্য সে যেই হোক, তাদের সবাই যেন দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। সম্ভবত এর কারণ তাঁদের পরনের পোষাক। হকিন্সের ঘর্মাক্ত, চওড়া, দেহ কালো চামড়া দিয়ে তৈরি একটা আঁটসাট জামা, হাঁটুর ঠিক উপরে গাঢ় লাল ফিতে দিয়ে বাঁধা পাতলুন এবং পিঙ্গল বর্ণের পশমের মোজা দিয়ে আবৃত। তাঁর পায়ে রয়েছে ঘোড়ায় চড়ার উপযোগী বহু ব্যবহারে ক্ষয় হয়ে যাওয়া একজোড়া গুলফ পর্যন্ত পরিহিত বুটজুতা।
‘আমি তাকে কীভাবে হত্যা করবো সেটা নিশ্চয়ই আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ না?
‘না। একটা ব্যাপারই এখানে প্রধান যে সে মারা গিয়েছে। তুমি যদি তাকে কেবল আহত করো তাহলে আমার কাছে সেটার কোনো মূল্য নেই।
‘আমি গৌড়ে পৌঁছাবার পরে সেখানে কীভাবে আপনার এই শের আফগানকে খুঁজে পাবো?
‘সে শহরের শাসনকর্তা এবং গৌড় দূর্গের সেনাছাউনির অধিপতি। চোখ কান খোলা রেখে অপেক্ষা করলেই তাঁর প্রাত্যহিক জীবনযাপন কালে তুমি তাকে দেখতে পাবে। আর কোনো প্রশ্ন আছে?”
হকিন্স এক মুহূর্ত ইতস্তত করে। আপনি কি আমাকে একটা সনদপত্র দেবেন–সেটা আমার সীলমোহরযুক্ত একটা চিঠি হতে পারে–যেখানে বিবৃত থাকবে যে আমি আপনার অধীনে কর্মরত।
না। শের আফগানের মৃত্যুর সাথে আমাকে যেন কোনোভাবেই জড়িত করা না হয়। আমি তোমাকে তোমার উদ্ভাবনকুশলতার জন্য টাকা দিচ্ছি। তুমি আমাকে বলেছে যে শাহের পক্ষে তুমি এমন অনেক স্পর্শকাতর অভিযান পরিচালনা করেছে।
ইংরেজ লোকটা নিজের স্থূলকায় কাঁধ ঝাঁকায়। আমার তাহলে আর কিছু জিজ্ঞেস করার নেই। আমি আগামীকাল যাত্রা শুরু করবো।’
জাহাঙ্গীর যখন কামরায় একা হয় তখন সে ধীর পায়ে তাঁর ব্যক্তিগত কক্ষের ঝুল বারান্দার দিকে এগিয়ে যায় যেখান থেকে যমুনা নদী দেখা যায়। বার্থোলোমিউ হকিন্স কি সফল হবে? তাকে দেখে যথেষ্ট কঠোর বলেই মনে হয় এবং দরবারের বেশিরভাগ ইউরোপীয়দের মত না, সে ভাঙা ভাঙা ফার্সী বলতে পারে। কিন্তু তার তাকে পছন্দ করার অন্যতম। প্রধান কারণ একটাই-লোকটা একজন ভিনদেশী। সে যদি নিজের লোকদের কাউকে পাঠাতো তাঁরা তাহলে হয়তো বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতো, যদিও সেটা কেবল বন্ধু বা কোনো আত্মীয় এবং সে কি পরিকল্পনা করছে সেটার খবর হয়তো শের আফগানের কাছে পৌঁছে যায় এবং তাকে পলায়ন করার জন্য যথেষ্ট সময় দেয়। বার্থোলোমিউ হকিন্সের সাথে এমন ভুল হবার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ এবং হিন্দুস্তানে কোনো গোত্র কিংবা কোনো পরিবারের সাথে তাঁর আত্মীয় সম্পর্কে সংবাদ নেই। হিন্দুস্তানে কোনো পরিবার বা গোত্রের আনুগত্য এবং কোনো মানুষ তাঁর কাছে কিছু পায় না। জাহাঙ্গীর কেন শের আফগানকে মৃত্যু কামনা করে সে বিষয়ে লোকটা কোনো কিছু প্রশ্নই করে নি। এমন আগ্রহহীনতা একটা চমকপ্রদ বিষয়…’
ইংরেজ ভাড়াটে সৈন্যের সাথে তাঁর সাক্ষাৎকারের বিষয়ে জাহাঙ্গীর কাউকে কিছু বলেনি। সুলেইমান বেগকে বিশ্বাস করে তাকে কথাটা সে হয়তো বলতে কিন্তু তাঁর দুধ-ভাই টাইফয়েড রোগে কিছুদিন আগেই মারা গিয়েছে। খসরুর কিছু অনুসারীর বিরুদ্ধে যারা আগ্রার দক্ষিণপূর্বের জঙ্গলে পালিয়ে গিয়েছিল সংক্ষিপ্ত একটা অভিযান শেষ করে তারা একত্রে ফিরে আসবার পরেই সে মারা যায়। সেঁতসেঁতে, গুমোট একটা তাবুতে মাত্র বারো ঘন্টা আগে অসুস্থতায় আক্রান্ত হয়ে শায়িত সুলেইমান বেগের জীবনের অন্তিম সময়গুলোর কথা স্মরণ করলে যখন বাইরে সীসার ন্যায় আকাশ থেকে বর্ষার অবিরাম ধারা এর ছাদে ঝরে পড়ছে এখনও জাহাঙ্গীরের গা শিউরে উঠে। সে আক্রান্ত হবার পরে এত দ্রুত জ্বরবিকারের শিকার হয় যে জাহাঙ্গীরকেও চিনতে পারে না। তার চিৎকারের দ্যোতনায় টানটান হয়ে থাকা ঠোঁট সাদা থুথুর গেঁজলায় ভরা আর পাতলা একটা চাদরে ঢাকা অবস্থায় দেহটা বিরামহীনভাবে মোচড়ায় আর কাঁপতে থাকে। সে তারপরে একদম নিথর হয়ে যায়, তাকে শেষ বিদায় জানাবার বা নিজের পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পুরোটা সময় বা সম্প্রতি খসরুর বিদ্রোহকালীন অন্ধকার দিনগুলোতে তাঁর বিজ্ঞ এবং আবেগহীন পরামর্শ জাহাঙ্গীরের কাছে কতটা গুরত্বপূর্ণ ছিল সেটা বলার কোনো সুযোগ সে পায় না।
সবকিছু যখন একদম ঠিকভাবে চলছে তখন সে সবার চেয়ে বেশি যাকে বিশ্বাস করতো তাঁর মৃত্যুটা সত্যিই বড় বেদনাদায়ক মনে হয়। সুলেইমান বেগের মৃত্যুর পরে গত দশ মাসে কোথাও আর কোনো বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেনি–এমনকি অসন্তোষের সামান্যতম আভাসও কোথাও দেখা যায় নি। তাঁর সাম্রাজ্য এখন সুরক্ষিত। পারস্যের যুদ্ধমান শাসক শাহ্ আব্বাসের কাছ থেকে কেবল হুমকির আশঙ্কা রয়েছে–যদি আবদুল রহমানের গুপ্তদূতদের আনীত বিবরণী সঠিক হয়–যিনি মোগলদের কাছ থেকে কান্দাহার পুনরায় দখল করার পরিকল্পনা করেছেন। জাহাঙ্গীর সাথে সাথে বিশটা ব্রোঞ্জের কামান আর দুইশ রণহস্তীসহ একটা শক্তিশালী বাহিনী উত্তরপশ্চিম দিকে প্রেরণ করায় নিজের পরিকল্পনা নিয়ে পুনরায় চিন্তা করতে শাহকে বাধ্য করেছে। জাহাঙ্গীরের সৈন্যরা কান্দাহারের উঁচু মাটির দেয়ালের কাছাকাছি পৌঁছাবার পূর্বেই তাঁর টকটকে লাল টুপি পরিহিত বাহিনী পশ্চাদপসারণ করে।