জাহাঙ্গীর আবার কক্ষে একা হওয়া মাত্র সে গভীরভাবে চিন্তা করে, নিজের সন্তানকে সে কঠোর শিক্ষা দিয়েছে, কিন্তু খসরু কি বিষয়টা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে? সে গোঁয়ার, স্বেচ্ছাচারী, আত্মদর্পী এবং সবচেয়ে বড় কথা উচ্চাভিলাষী। তার নিজেরই খুব ভালো করে জানা আছে যে উচ্চাকাঙ্খ সহজে গোপন করা যায় না। তার আব্বাজান আকবর তাকে হয়ত তাঁর আরাধ্য সিংহাসন থেকে বঞ্চিত করবেন এই ভয়ের কারণে নিজের জীবনের প্রায় বিশটা বছর কি সে যন্ত্রণায় দগ্ধ হয় নি? সে নিজে কি বিদ্রোহ করে নি? সে ঠিক যেমনটা করেছিল, খসরুকে জানার জন্য অপেক্ষা করতে হবে যে সে কি তাকে, তার জ্যেষ্ঠ সন্তানকে, বিদ্রোহী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করবে। এবং এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য প্রচুর সময় পাওয়া যাবে। আল্লাহতা’লা সহায় থাকলে, সে এখনও আরও বহু বছর বেঁচে থাকবে।
কিন্তু তাঁর অন্য সন্তানদের কি মনোভাব? তাঁর আব্বাজানের সাথে তার বিরোধ দীর্ঘ সময়ের জন্য তাঁদের কাছ থেকে তাকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। আকবরের দরবারে তার প্রত্যাবর্তনের পরে একজন পিতা আর তার সন্তানদের ভিতরে সম্পর্ক যতটা ঘনিষ্ঠ হওয়া উচিত সেভাবে সম্পর্ক পুনর্গঠন করাটা তাঁর কাছে বেশ কঠিন বলে মনে হয়। বহু বছর পূর্বে মরমী সুফি সাধক শেখ সেলিম চিশৃতির, যিনি তাঁর নিজের জন্ম সম্পর্কে পূর্বেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, জাহাঙ্গীরকে বলা কথাগুলো তাঁর মানসপটে ঝলসে যেতে সে ভ্রু কুঁচকে ফেলে। নিজের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে অনিশ্চিত এক যুবরাজ হিসাবে সে বৃদ্ধ লোকটার কাছে পরামর্শের জন্য গিয়েছিল। তোমার চারপাশে যারা রয়েছে তাদের লক্ষ্য করো। তুমি কারো উপরে নির্ভর করার ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকবে এবং বিশ্বাসের উপর কোনোকিছু ছেড়ে দিবে না, রক্তের বন্ধনে তুমি যাদের সাথে সম্পর্কিত এমনকি তাঁদের কাছ থেকেও… এমনকি তোমার যারা সন্তান হবে,’ বিজ্ঞ সুফি সাধক বলেছিলেন। ‘উচ্চাকাঙ্খর সবসময়ে দুটো দিক রয়েছে। এটা মানুষকে মহত্বের দিকে ধাবিত করে কিন্তু তাদের আত্মাকে বিষাক্তও করতে পারে…’ তার এই সতর্কবাণীর প্রতি মনোযোগ দেয়া উচিত। সর্বোপরি, সুফি সাধক যা কিছু সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন সে সবের অধিকাংশই ইতিমধ্যে ঘটেছে। সে বাস্তবিকই সম্রাট হয়েছে এবং তাঁর সন্তানদের একজনকে উচ্চাকাঙ্খ আদতেই কলুষিত করেছে।
খসরুর প্রতি তাঁর ক্রোধের তীব্রতা সম্ভবত এ কারণেই এত বেশি তীব্র। তাঁর মনে আছে কীভাবে খসরুর সাথে যুদ্ধের মাত্র দু’দিন আগে, তাঁর সৈন্যরা একটা ছোট মাটির দেয়াল ঘেরা গ্রাম দখল করেছিল। সেই গ্রামের পলিত কেশ সর্দার জাহাঙ্গীরের সামনে প্রণত হবার পরে, তার পরনের খয়েরী রঙের অধধায়া আলখাল্লার একটা পকেট থেকে তিনটা তামার পয়সা বের করে দাবি করে সেগুলো তাকে খসরুর গুপ্তদুতের একটা বাহিনী দিয়েছে। সে নিজের আনুগত্যের স্মারক হিসাবে দৃশ্যত কম্পিত আঙুলে জিনিষগুলো ধরে জাহাঙ্গীরের হাতে তুলে দেয়। জাহাঙ্গীর মুদ্রাগুলো খুটিয়ে দেখতে খেয়াল করে যে আপাত ব্যস্ততায় তৈরি করা প্রতিটি মুদ্রায় খসরুর প্রতিকৃতি খোদাই করা রয়েছে এবং খসরুকে হিন্দুস্তানের সম্রাট ঘোষণা করে প্রতিকৃতির চারপাশে বৃত্তাকারে বাণী মুদ্রিত রয়েছে। জাহাঙ্গীর ক্রোধে এতটাই উন্মত্ত হয়ে উঠে যে মুদ্রাগুলো কাছে রাখা ধৃষ্টতা দেখাবার কারণে সর্দারকে চাবুক মারার আদেশ দেয়, কামারশালায় তখনই মুদ্রাগুলোর আকৃতিনাশ করতে আদেশ দেয় এবং একটা ফরমান জারি করতে বলে যে ভবিষ্যতে কারো কাছে এমন মুদ্রা পাওয়া গেলে সেগুলো রাখার দায়ে শাস্তি হিসাবে তার ডান হাতের আঙুলগুলো কেটে নেয়া হবে। সুলেইমান বেগ সদারকে ক্ষমা করার জন্য জাহাঙ্গীরকে রাজি করাবার আগেই সর্দারের হাড্ডিসার দেহ কোমর পর্যন্ত নগ্ন করে গ্রামের চৌহদ্দির ভিতরে অবস্থিত একমাত্র গাছের সাথে বাধা হয় আর জাহাঙ্গীরের সবচেয়ে শক্তিধর দেহরক্ষী হাতে সাত বেণীর চাবুক নিয়ে বাতাসে শিস তুলে কশাঘাতের মহড়া দিতে থাকে। সে খুবই ভাগ্যবান সুলেইমান বেগকে সে তার যৌবনের সময় থেকে পাশে পেয়েছে–একজন বিশ্বস্ত বন্ধু যে তার মেজাজ মর্জি সহজপ্রবৃত্তিতে আঁচ করতে পারে এবং এখন বিজ্ঞ পরামর্শদাতা হিসাবে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ রাখছেন।
কিন্তু পারভেজ আর খুররম–খসরুর চেয়ে খুব বেশি ছোট না খোল আর চৌদ্দ বছর বয়স–তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে তাঁদের সৎ-ভাইয়ের প্রচেষ্টা এবং সেজন্য তাঁর প্রদত্ত শাস্তি সম্বন্ধে তারা কি চিন্তা করছে? পারভেজের জননী মোগলদের এক প্রাচীন গোত্রের মেয়ে হলেও খসরুর মত, খুররমের জননী রাজপুত রাজকন্যা এবং খুররম বড় হয়েছে আকবরের কাছে যিনি প্রকাশ্যে তাকে বিশেষ প্রশ্রয় দিতেন। দুই যুবরাজ বিশেষ করে খুররম, মনে করতেই পারে সিংহাসনে তাঁদের দাবি খসরুর মতই জোরালো। অন্ত ত তার সবচেয়ে ছোট ছেলে শাহরিয়ারের উচ্চাকাঙ্খ সম্বন্ধে তাঁর এখনই উদ্বিগ্ন হবার প্রয়োজন নেই এটাই যা স্বস্তির বিষয়, সে এখনও শাহী হারেমে তার জননী, জাহাঙ্গীরের উপপত্নির সাথে বাস করছে।
তাকে যত শীঘ্রি সম্ভব আগ্রায় নিজের অল্পবয়সী সন্তানদের কাছে ফিরে যেতে হবে। খসরু আর তাঁর অনুসারীদের প্রতি আপোষহীন আচরণের দ্বারা সে প্রতিপাদন করেছে যে সম্রাট হিসাবে সে কোনো ধরনের মতদ্বৈধ সহ্য করবে না। কিন্তু সেইসাথে সে এখনও যে একজন স্নেহময় পিতা সে অবশ্যই তাঁদের সেটাও দেখাবে আর খসরুর বিশ্বাসঘাতকতার কারণেই কেবল সে এমন নির্মম আচরণ করতে বাধ্য হয়েছিল…
১.০২ অতর্কিত আততায়ী
‘তুমি নিশ্চিত কি করতে হবে তুমি বুঝতে পেরেছো?’ জাহাঙ্গীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ইংরেজ লোকটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। বার্থোলোমিউ হকিন্সের সাথে এটা কেবল তাঁর দ্বিতীয় মোলাকাত কিন্তু এটাই তার মাঝে প্রত্যয় উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট যে লোকটা আততায়ীর ভূমিকায় ভালোই উতরে যায়। হকিন্স ভাঙা ভাঙা ভুলভালো পার্সীতে কথা বলে যা সে ইস্ফাহানে পারস্যের শাহের বাহিনীতে ভাড়াটে সৈন্য হিসাবে কাজ করার সময় রপ্ত করেছিল কিন্তু নিজের সন্তুষ্টির স্বার্থে তাকে পরীক্ষা করার জন্য জাহাঙ্গীরের কাছে সেটাই যথেষ্ট।