জাহাঙ্গীর দু’জনকে আঁতকে উঠতে শুনে। তাদের শাস্তি দেয়ার ধারণাটা সে কথা শুরু করার ঠিক আগ মুহূর্তে আকস্মিক প্রেরণার একটা ঝলকের মত তার কাছে প্রতিভাত হয়েছে। সে জানে তার দাদাজান হুমায়ুন অপরাধের উপযুক্ত শাস্তিবিধান করতে অভিনব এবং কখনও উদ্ভট উপায় খুঁজে বের করতে পারার জন্য নিজেকে নিয়ে গর্ব বোধ করতেন। সেও এখন সেটা পারে। সে অবশ্য অপকর্মের সহযোগীদের নিয়ে আর কোনো সময় নষ্ট করতে আগ্রহী নয় আর তাই ঘুরে খুসরুর দিকে তাকায় যে দু’হাত অনুনয়ের ভঙ্গিতে জোড়া করে, বিপদে মিহমান লোকের মত ফুঁপিয়ে কাঁদছে এবং বিড়বিড় করে কিছু বলছে জাহাঙ্গীর ঠিক বুঝতে পারে না কিন্তু যা শুনে দুর্বোধ্য মনে হয়। সে নিজেকে সংযত করে উঠে দাঁড়িয়ে, তার সন্তানকে তাঁর অনিবার্য বিপর্যয়ের মাঝে প্রেরণ করবে যে শব্দগুলো সেগুলো উচ্চারণ করতে নিজেকে প্রস্তুত করে।
‘খসরু, তুমি বৈরী বিশ্বাসঘাতকদের নিয়ে একটা বাহিনী গঠন করেছিলে যাদের একমাত্র উদ্দেশ্য আমাকে–তোমার আব্বাজান এবং ন্যায়সঙ্গত মোগল সম্রাট ক্ষমতাচ্যুত করা এবং তোমার জন্য আমার সিংহাসন জবরদখল করা। রক্তপাত ঘটাবার জন্য তুমিই দায়ী এবং ন্যায়পরায়ণতার স্বার্থে তোমাকে রক্তেই এর মূল্য পরিশোধ করতে হবে। তার কণ্ঠস্বরের রুক্ষতার অকৃত্রিমতা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই এবং তাঁর উচ্চারিত প্রতিটা শব্দ তাঁর সংকল্প ব্যক্ত করে। খসরু নিজেও সেটা ভালো করেই জানে এবং ভয়ে সে নিজের মূত্রথলির উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। জাহাঙ্গীর তাকিয়ে দেখে খসরুর পরনের সুতির পাজামায় একটা গাঢ় দাগ ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে এবং টপটপ করে পড়তে থাকা প্রস্রাব মাটিতে জমে হলুদ একটা ডোবার সৃষ্টি করে।
খসরু যে মানসিক অবস্থায় নিজেকে নিয়ে এসেছে সেজন্য করুণার একটা স্রোতধারা তাকে জারিত করে। যদিও কিছুক্ষণ আগেও খসরুর শিরোচ্ছেদের আদেশ দেয়ার পুরো অভিপ্রায় তার মাঝে বিরাজ করছিল, সহসাই সে আর তার মৃত্যু কামনা করে না। ইতিমধ্যে যথেষ্ট রক্তপাত আর দুর্ভোগ সহ্য করতে হয়েছে… কিন্তু আমি তোমার জান বখশ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সে নিজেকে বলতে শুনে। তুমি আমার সন্তান এবং আমি তোমাকে হত্যা করবো না। তোমাকে এর পরিবর্তে কারাগারে বন্দি করে রাখা হবে যেখানে অনাগত মাস বছরের গণনায় তুমি সীমালঙ্নের ব্যাপারে চিন্তা ভাবনার প্রচুর সময় পাবে যা তোমাকে তোমার স্বাধীনতা আর সম্মান খোয়াতে বাধ্য করেছে।’
খসরু, আজিজ কোকা আর হাসান জামালকে সরিয়ে নিয়ে যাবার পরে জাহাঙ্গীর তার দুধ-ভাইয়ের দিকে ঘুরে তাকায়, যে তখনও পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। সুলেইমান বেগ, শূলবিদ্ধ বন্দিদের যারা এখনও বেঁচে রয়েছে, আমার সৈন্যদের আদেশ দাও তাঁদের কণ্ঠনালী কেটে দিতে। তাঁরা যথেষ্ট যন্ত্রণা সহ্য করেছে। তাদের মৃতদেহগুলোকে একটা সাধারণ কবরে দাফন করে, শূলগুলো তুলে ফেলে তার উপরে তাজা মাটি ছড়িয়ে দাও। যুদ্ধে যারা আহত হয়েছে–শত্রু কিংবা মিত্র নির্বিশেষে আমাদের হেকিমদের তাঁদের চিকিৎসা করতে বলো। আজ কি পরিমাণ রক্তপাত হয়েছে তাঁর কথা আমি ভুলে যেতে চাই।’
*
এক সপ্তাহ পরে, বারগাত দূর্গে অবস্থানের সময় যে স্থানটা, সে তার বাহিনীকে যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে পুনর্গঠিত হবার সময় দিতে, অস্থায়ী সদরদপ্তর করেছে, জাহাঙ্গীর লাহোরের শাসনকর্তার কাছ থেকে সদ্য প্রাপ্ত দীর্ঘ চিঠিটা মনোযোগ দিয়ে পাঠ করে যেখানে আজিজ কোকা আর হাসান জামালের ভাগ্যে কি ঘটেছে সেটার বিবরণ রয়েছে। জাহাঙ্গীর চিঠিটা পড়ার সময়ে, পুরো দৃশ্যপটটা মানসচক্ষে দেখতে পায়–নিজেদের আভিজাত্য ভুলে ধ্বস্তাধ্বস্তি করতে থাকা দু’জন লোক, যাদের কাছ থেকে তাদের সমস্ত মর্যাদা কেড়ে নেয়া হয়েছে, সদ্য ছাল ছাড়ান তীব্র দুর্গন্ধযুক্ত রক্তাক্ত পশুচামড়ার ভিতরে তাঁদের ঢুকিয়ে সেলাই করে দেয়া হয়েছে। প্রদেশের শাসককর্তা জানিয়েছেন, পশুর মাথাটা তখনও চামড়ার সাথে যুক্ত ছিল এবং তাঁদের শহরের ভিতর দিয়ে প্রদক্ষিণ করাবার সময় উপস্থিত লোকজন যখন বিদ্রূপ করে আর পঁচা তরকারি আর পাথর তাঁদের দিকে ছুঁড়ে মারে তখন চামড়ার ভিতরে বন্দিদের প্রতিটা ব্যর্থ বেপরোয়া প্রয়াসের সাথে সাথে পশুর মাথাগুলো উদ্ভট ভঙ্গিতে আঁকি খায়। আজিজ কোকা, গাধার চামড়া দিয়ে তাকে মুড়ে দেয়া হয়েছিল, প্রচণ্ড গরমে চামড়াটা শুকিয়ে সংকুচিত হলে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যান। মোষের চামড়ার ভিতর থেকে হাসান জামালকে টেনে বের করার সময় তিনি বেঁচে থাকলেও প্রায় সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিলেন। তিনি এখন লাহোরের ভূগর্ভস্থ কারাপ্রকোষ্ঠে রয়েছেন। শাসনকর্তা, তার চিঠির একেবারে শেষে, জানতে চেয়েছে জাহাঙ্গীর কি হাসান জামিলকে প্রাণদণ্ড দিতে আগ্রহী।
জাহাঙ্গীর মন্থর পায়ে জানালার দিকে হেঁটে যায় এবং বালুকাময়, নিরানন্দ দৃশ্যপটের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার এখন পুরো ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করার সময় আছে, নিজের আরোপিত শাস্তির নৃশংসতায় সে খানিকটা লজ্জিত বোধ করে যদিও তাঁরা এই শাস্তির উপযুক্ত এবং অন্যান্য বিদ্রোহীদের বিদ্রোহ প্রয়াস থেকে বিরত রাখবে। সে যখন ক্রোধে উন্মত্ত তখন ক্ষণিকের উত্তেজনায় কাজটা হয়েছে। তার আবেগ এখন অনেক প্রশমিত তার কেবলই মনে হতে থাকে সে যদি ভিন্নভাবে ব্যাপারটা নিষ্পত্তি করতে পারতো। একজন দুর্বল শাসকই কেবল করুণা প্রদর্শনের ব্যাপারে ভীত হতে পারেন… সে হাসান জামালের মৃত্যু কামনা করেছিল। লোকটা যে প্রাণে বেঁচে গিয়েছে সেটা কেবল অলৌকিক কোনো কারণে সম্ভব হয়েছে কিন্তু এটা তাকে ক্ষমাশীলতা প্রদর্শনের একটা সুযোগ দিয়েছে যা খসরুর বিদ্রোহের কারণে তাঁর অমাত্যদের ভেতরে সৃষ্ট বিরোধ প্রশমিত করার কাজ শুরু করবে। সে তখনই একজন খুশনবিশকে ডেকে পাঠায় এবং লাহোরের শাসনকর্তার কাছে নিজের জবাব শব্দ করে পাঠ করতে থাকে। হাসান জামালকে যথেষ্ঠ শাস্তি দেয়া হয়েছে। তাকে বাঁচিয়ে রাখা হবে।’