শিক্ষা সম্বন্ধে বক্তব্য শেষ করার আগে আমি আমেরিকা থেকে আরেকটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরব, তুলে ধরবো এ কারণে যে আমেরিকা অন্যান্য দেশের চাইতে খারাপ। তারপরেও হলো সর্বাধুনিক দেশ; সে-কারণে বিপদগুলোর নিরসনের চাইতে বৃদ্ধিপ্রাপ্তি ঘটছে অত্যাধিক হারে। নিউইয়র্ক স্টেটে জনসাধারণের পয়সায়ও রাষ্ট্রের অনুমতি ছাড়া কোন স্কুল খোলা যায় না। সাম্প্রতিক একটি আইনের ঘোষণা হলো “প্রতিষ্ঠিত সরকারকে শক্তিবলে, প্রতিহিংসা বলে অথবা অন্য কোন বেআইনী পদ্ধতিতে উৎখাত করার মতবাদ শিক্ষা দেয়ার মত কিছু পাঠ্যসূচীতে যোগ করা হলে তেমন কোন প্রতিষ্ঠানকে সরকার স্কুল খোলার অনুমতি দেবে না। নিউ রিপাবলিক পত্রিকা ঘোষণা করেছে আরো, এ সরকার সে সরকারের প্রভেদের কোনো সীমারেখা নেই। সুতরাং যুদ্ধের সময়ে কাইজারের সরকারকে উৎখাত করা যাবে না। এ মতবাদ শিক্ষা দেয়াকে বেআইনী করা উচিত। সোভিয়েত সরকারের বিরুদ্ধে ডেনিকিন এবং কেলচাকদের সমর্থনকেও উচিত বেআইনী ঘোষণা করা। এরকম ফলাফল অপ্রত্যাশিত, তবে খারাপ খসড়ার দরুণ মাঝে মাঝে প্রকৃত ফলাফল প্রকাশিত হয়ে পড়ে। এই আইন অনুসারে কেবল সে সমস্ত লোক এই সমস্ত স্কুলে শিক্ষকতা করতে পারবে যারা বিশেষ বিশেষ স্টেটের সরকার এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের প্রমাণ দেখাতে পারবে। যারা সে বিশেষ স্টেটের সরকার এবং যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের বদলে অন্য ধরণের সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেছে, কখন বলেছে, এবং কোথায় বলেছে তার কোন হদিশ না জেনেও তাদেরকে স্টেটে চালিত স্কুলে শিক্ষকতা করতে দেয়া হবেনা। যে কমিটি এ সমস্ত আইন প্রণয়ন করেছে, সে সম্বন্ধে নিউ রিপাবলিক কাগজ লিখেছে যে শিক্ষক, বর্তমান সামাজিক পদ্ধতির সঙ্গে একমত নয় তাকে অবশ্যই চাকুরি ছেড়ে দিতে হবে। যে লোক সামাজিক পরিবর্তনের থিয়োরির ব্যাপারে ঝগড়া করতে রাজি নয়, তাদের ওপরই যুবক এবং বুড়োদেরকে দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার ভার দেয়া হয়। সুতরাং নিউইয়র্ক স্টেটের নিয়মানুসারে যিশুখৃষ্ট নিউইয়র্কে গিয়ে বলতেন, “ছোট ছেলেমেয়েরা আমার কাছে আসার জন্য কষ্ট পাচ্ছে। নিউইয়র্কের স্কুল বোর্ডের প্রেসিডেন্ট তখন তাকে জবাব দিতেন, “জনাব আপনি সামাজিক পরিবর্তন সম্পর্কে বাদানুবাদে যে আগ্রহী তার কোনো প্রমাণ আমি দেখছিনে। আমি ঠিকই শুনেছি আপনি স্বর্গরাজ্যের ওকালতি করেন, কিন্তু খোদাকে অশেষ ধন্যবাদ এ দেশ হচ্ছে প্রজাতন্ত্র। নিউইয়র্ক রাজ্যের সরকারের সঙ্গে আপনার স্বর্গরাজ্যের সরকারের আকাশ পাতাল প্রভেদ। সুতরাং কোনো ছেলেমেয়েকে আপনার কাছে যেতে দেয়া হবে না।“ যদি তিনি উপরোক্ত উত্তর দিতে অসমর্থ হন তাহলে আইনের শাসন তার কাঁধে যে দায়িত্ব চাপিয়েছে তা ঠিক ঠিকভাবে পালন করছেন না।
এ ধরণের প্রতিক্রিয়া খুবই ভয়ঙ্কর। যুক্তির খাতিরে ধরে নেয়া যাক নিউইয়র্ক রাজ্যের সরকার এবং সমাজব্যবস্থা আমাদের এ গ্রহে সবচেয়ে উত্তম, কিন্তু তা সত্ত্বেও ও দুটোকে আরো ভালো করা যেতে পারে একথা আমরা সত্য বলে ধরে নিতে পারি। যদি কোন ব্যক্তি এ স্পষ্ট যুক্তিকে বিশ্বাস করে তাহলে তাকে স্টেট চালিত স্কুলে শিক্ষকতা করার সুযোগ দেয়া হবে না। সুতরাং আইনের ঘোষণা অনুসারে শিক্ষকদেরকে হয়ত কপট নয়ত বোকা হতে হবে। একই সংস্থা তা রাষ্ট্র অথবা ট্রাষ্টের ফেডারেশন যাই হোক না কেননা একচেটিয়াভাবে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখার ফলে নিউইয়র্ক রাজ্যের আইন ব্যবস্থার মধ্য থেকে ক্রমবর্ধমান বিপত্তির দৃষ্টান্ত সমূহের কয়েকটা তুলে ধরা হলো। শিক্ষার ক্ষেত্রে সমস্ত ক্ষমতা রাষ্ট্রের হাতে থাকায় রাষ্ট্রের না পছন্দ কোন মতবাদ শিশুদেরকে শুনতে নিবৃত্ত করা হয়। আমার বিশ্বাস এখনো কিছু সংখ্যক মানুষ আছে যারা গণতন্ত্রকে জনসাধারণের চাইতে আলাদা করে দেখে। সে যাহোক তাহলো এক ধরণের অবাস্তব পরিকল্পনা। রাষ্ট্র হলো বিভিন্ন চাকুরেদের দ্বারা গঠিত যারা বিভিন্ন উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত, এবং সুখে স্বচ্ছন্দে বেঁচে থাকার মতো টাকা পয়সা আয় করে থাকে। আমলাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে আমলাতান্ত্রিকতার মধ্যে পরিবর্তন আনাই হলো তাদের একমাত্র সম্ভাব্য পরিবর্তনশীল পন্থা। সমর উত্তেজনার সুযোগ গ্রহণ করে অধীনস্থ কর্মচারীদের ওপর দমননীতি যে চালাবে তাদের পক্ষে এটা খুবই স্বাভাবিক। অধীনস্থ কোন কর্মচারী যদি তাদেরকে বাধা দেয় তাহলে এ সুযোগে অনাহারে রাখার ক্ষমতাও তারা করায়ত্ত করে থাকে। শিক্ষার মতো অন্যান্য যে সমস্ত উপাদানে এভাবে মনকে গড়ে তোলে তা ভয়ঙ্কর। এর ফলে প্রগতি স্বাধীনতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টার সম্ভাবনার অবসান ঘটে। তাহলেও সমস্ত প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে একচেটিয়াভাবে একটি সংস্থার অধীনে আনয়ন করার স্বাভাবিক পরিণতি আলাদা হতে পারে না।
ধর্মের ব্যাপারে সহনশীলতার পরিমাণ কিছু বৃদ্ধি পেয়েছে আগের তুলনায়, সেহেতু মানুষ ধর্মকে এখন তেমন প্রয়োজনীয় উপাদান মনে করে না। বর্তমানে রাজনীতি এবং অর্থনীতি ধর্মের পূর্বতন স্থান অধিকার করেছে, অত্যাচার নির্যাতনের মাত্রা ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তার পরিধি শুধুমাত্র একটি পার্টির মধ্যে সীমাবদ্ধ কোন কারণেই নয়। যে কোন ধর্মতান্ত্রিক দেশের তুলনায় রাশিয়াতে মতামতের ওপর নির্যাতন করা হয় সবচেয়ে বেশি। পেত্রোগ্রাদে আলেকজাণ্ডার ব্লক নামে একজন বিখ্যাত রাশিয়ান কবির সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল, যাকে কারাবাসে মৃত্যুবরণ করতে হয়। বলশেভিকরা তাকে সৌন্দর্যতত্ত্ব সম্বন্ধে শিক্ষাদান করতে নিয়োগ করেছিল কিন্তু তারা তার শিক্ষা পদ্ধতিকে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গীতে রূপ দেয়ার জন্যে চাপ দিচ্ছিলো বলে তিনি অভিযোগ করেছিলেন। সে যা হোক অনাহার এড়িয়ে যাবার জন্যে ছন্দের সঙ্গে মার্কসবাদের সম্বন্ধ আবিষ্কার করার জন্যে তিনি যারপর নাই চেষ্টা করলেন। বলতে গেলে তা ছিল অসম্ভব, কেননা, একবছর পূর্বে বলশেভিক সরকার ক্ষমতায় আরোহণ করেছে, যে বিশ্বাসের ওপর তাদের রাজত্ব কায়েম হয়েছে সে বিশ্বাসের সঙ্গে সাযুজ্য রক্ষা করে সবকিছুর সমালোচনা তখনো মুদ্রিত হয়নি।