চীনা জীবন যাপন পদ্ধতির গুরুতর দোষ হলো একটি; তা চীনাকে কলহপরায়ণ জাতিগুলোর বিরুদ্ধে বাধা দেবার মতো শক্তিশালী করেনি। সমগ্র পৃথিবী চীন দেশের মতো হলে আরো সুখময় হতে পারত। যে পর্যন্ত অন্যান্য জাতিসমূহ যুদ্ধপ্রিয় এবং উৎসাহী থাকবে সে পর্যন্ত চীনদেশ যা এখন আর বিচ্ছিন্ন নয়, তাদের জাতীয় স্বাধীনতা অটুট রাখতে চাইলে আমাদের কিছু দোষের অনুকরণ করতে হবে। এ অনুকরণ যে উন্নতি তা ভেবে আমাদের আত্মপ্রসাদ লাভ করা একদম অনুচিত।
০৯. ভালো মানুষদের কথা
একশ বছর আগে জেরেমি বেনথাম নামে একজন দার্শনিক সর্বসাধারণের কাছে মন্দলোক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ছোটবেলা যেদিন সে নামটির সঙ্গে আমার সর্বপ্রথম পরিচয় হয় সেদিনটির কথা এখনো আমার খেয়াল আছে। রেভারেণ্ড সিডনি স্মিথ বলেছিলেন। বেনথামের মতে মৃতা মাতামহীর মাংস দিয়ে স্যুপ তৈরি করা উচিত। নীতিগতভাবে এ ধরণের ব্যঞ্জন তৈরি করার কাজকে তখন আমার কাছে রীতিমতো বিগর্হিত ঠেকেছিল। সুতরাং আমার মনেও বেনথাম সম্পর্কে খারাপ ধারণা বদ্ধমূল হলো। এর অনেক পরে আমি আবিষ্কার করলাম, যেভাবে প্রচলিত পদ্ধতি অনুসারে শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিরা সতোর সুফল ভোগ করার জন্যে যে ধরণের বেপরোয়া মন্তব্য করে থাকে, উক্ত মন্তব্যটিও ছিল সেরকমের একটি। তার বিরুদ্ধে সাংঘাতিক অভিযোগের কারণও আমি অনুধাবন করতে সমর্থ হলাম। তাহলে তার প্রদত্ত সংজ্ঞা সেখানে তিনি বলেছেন, সেই-ই ভালো মানুষ যে ভালো কাজ করে। সৎ পাঠকের মনে সংজ্ঞাটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যে ধারণা জন্মাবে তা সকল রকমের বিশুদ্ধ নৈতিকতার পরিপন্থী। যেখানে কান্ট বলেছেন, শুধুমাত্র উপকৃত জনের প্রতি স্নেহাধিক্যবশত কৃতকর্মসমূহ ধর্মীয় আখ্যা পেতে পারেনা, সেখানে তিনি কিরকম অভিভূত। কিন্তু নৈতিক নিয়মের প্রেরণায় কৃতকর্মসমূহ অপ্রিয় হলেও ধর্মীয়। এও আমরা সকলে জানি যে, ধর্মই ধর্মের শেষ পুরস্কার: কিন্তু গভীরভাবে অনুসন্ধান করলে তেমনি এটাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যেমন একজন রোগী নিজেই নিজের শাস্তি ভোগের কারণ। সুতরাং কান্ট বেনথামের চেয়ে আরো একজন বিনম্র চিন্তাবিদ এবং তিনি তাদেরই কল্যাণ কামনা করেন যারা ধর্মকে ধর্মের কারণেই ভালোবাসেন।
বেনথাম ভালো মানুষের পুরোপুরি সংজ্ঞায়ন করে প্রভূত কল্যাণ করেছেন। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী চল্লিশটি বছর বাস্তব বুদ্ধিবৃত্তিক এবং নীতির দিক দিয়ে অবিশ্বাস্য রকমে উন্নততর যুগ। এই সময়েই হয়েছিল সংস্কার আইন, যার ফলে পার্লামেন্ট সদস্যপদের আসন অধিকার করল মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়, পূর্বের মতো অভিজাত শ্রেণী নয়। এই আইনটি ছিল ইংল্যাণ্ডে গণতন্ত্রের প্রবর্তন করার পদক্ষেপসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক এবং এরই সঙ্গে সঙ্গে উল্লেখযোগ্য সংস্কারও সাধিত হলো! যেমন উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে জ্যামেইকার দাস বৃত্তির অবসান। এ সময়ে ছাৈটখাট চুরির অপরাধেও মানুষকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো হতো, কিন্তু অতি অল্প সময়ের মধ্যে মৃত্যুদণ্ডকে শুধু খুন অথবা অনুরূপ অপরাধের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ করা হলো। যে শস্য-আইনের ফলে খাদ্যবস্তু দুর্মূল্য হয়ে গেল এবং দুর্ভিক্ষ ভয়াবহ আকার ধারণ করল, ১৮৪৬ সালে তা রহিত করা হলো। ১৮৭০ সালে বাধ্যতামূলক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তিত হলো। ভিক্টোরিয় যুগের নিন্দা করা এখন প্রায় ফ্যাশনে দাঁড়িয়েছে; কিন্তু আমার ধারণা সে যুগের মহৎ গুণাবলীর যে প্রমাণ আমরা পেয়ে থাকি, আমাদের যুগে তার অর্ধেকও বিরল। সে যা হোক, তার আলোচনা এখানে অপ্রাসঙ্গিক কিন্তু আমার যা বলবার বিষয়, তাহলো ঐ বছরগুলোতে যে উন্নতি সাধিত হয়েছিল তার অধিকাংশ অবশ্যই বেনথামের প্রভাবে হয়েছিল। এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই যে শতাব্দীর শেষভাগে ইংল্যাণ্ডের জনসাধারণ যে রকম সুখ-সন্তষ্ট দিন যাপন করত তেমনটি আর কখনো ছিল না। বেনথামের দর্শন এত অগভীর ছিল যে, সে অগভীরতাকে তিনি তার সাফল্য জ্ঞান করতেন। আমাদের আলোকিত যুগে অনায়াসে বলে দিতে পারি যে, ও জাতীয় মতবাদ কিংবা ধারণা অবিশ্বাস্য এবং অযৌক্তিক হলেও বেনথামের মত আমাদের উপযোগবাদ পরিহার করার ক্ষেত্রে আবিষ্কার করতে সাহায্য করবে।
ভালোমানুষ বলতে কি বোঝায় তা আমরা সকলেই জানি। আদর্শ ভালোমানুষ মদ খান না, ধুমপান করেন না, খারাপ বাক্য পরিহার করেন, ভদ্রলোকের সঙ্গে এমন সংযতভাবে আলাপচারী করেন যেন সেখানে ভদ্র মহিলা আছেন। নিয়মিত গির্জায় যান এবং সব বিষয়ে সঠিক ধারণা রাখেন। অন্যায় করার ব্যাপারে তার হৃদয়ে প্রবল ভীতি বিরাজিত এবং তিনিও জানেন যে, পাপ বাঁচিয়ে জীবন ধারণ করা হলো আমাদের বেদনার্ত কর্তব্য, তার পরেও পাপের ব্যাপারে তার আতঙ্কিত মনোভাব থেকে যায়। মধ্যবয়স্ক নাগরিকেরা যে সকল মতামত অবলম্বন করে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে আরোহণ করেছেন, যখন তাদের জ্ঞানের পরিপক্কতা সম্বন্ধে প্রশ্ন করে বসেন কেউ তাদের অজ্ঞতা থেকে তরুণদেরকে রক্ষা করাকে নিজেদের পবিত্র কর্তব্য বলে মনে করেন। পেশাগত কঠোর পরিশ্রম ছাড়াও ভালো লোকেরা ভালো কাজে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। যেমন তিনি দেশকে সামরিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার উৎসাহ দিতে পারেন, কারখানার উন্নতি বিধান করতে পারেন। কারখানার মজুর এবং তাদের সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে সহনশীলতা এবং ধর্মের বাণী প্রচার করতে পারেন, যাতে তারা আসল পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে শাস্তি ভোগের কারণ না হয়। অথবা তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি হয়ে বিপরীত আদর্শের অধ্যাপক নিযুক্ত করে জ্ঞানের উদ্দেশ্য প্রণোদিত পক্ষপাতমূলক শ্রদ্ধার নিরসন করতে পারেন, সর্বপরি তার নৈতিকতা সংকীর্ণ হলেও অবশ্যই অক্ষত থাকা চাই।