সতৃষ্ণ নয়নে গরম ধোসার দিকে তাকিয়ে অগত্যা আমাকেও চুমুক দিতে হল কফির কাপে।
রাখালরাজ সত্যিই বেশি বকেন। শশব্যস্তে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–আমার মাইশোর সিল্কের কারবার, স্যার। চৌরঙ্গিতে শোরুম আছে। দরকার থাকলে বলবেন–লাভ নেব না।
আমি ব্যাচেলর, বলতে-বলতে বেরিয়ে গেল ইন্দ্রনাথ।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাবি খেলেন রাখালরাজ।
গাড়িতে উঠে ব্যাজার মুখে বললে প্রেমাংশু–পণ্ডশ্রমই সার। বিকেল পাঁচটা থেকে ছটার মধ্যে ললিতমোহন কোথায় ছিল, কার কাছে ছিল–এখনও তা রহস্য।
টফির বাক্সর ডালাটা এঁটে গিয়েছিল। আঙুলের চাড় মেরে ইন্দ্রনাথ বললে–রহস্যের। সমাধান আমার হাতে।
সে কীরে?
কবিতাও উৎসুক চোখে তাকাল বাক্সটার দিকে। টিনের বাক্স। ওপরে ফুলের ছবি।
আমি বললাম–কিন্তু তুই জানলি কী করে বাক্সটা ওখানে আছে?
ডালাটা সত্যিই এঁটে গিয়েছিল। এবার দু-হাত লাগিয়ে বললে ইন্দ্রনাথঃ
দুটো কারণে। প্রথমত বিপদ এলে মানুষমাত্রই আগে প্রাণপ্রিয় বস্তুটা বাঁচাতে চায়। পুলিশ দেখেই শ্যামলেন্দু গ্যারেজে পালাল কেন? আরও তো জায়গা ছিল। দ্বিতীয় কারণটা আরও সহজ। প্রেমাংশু এটা-ওটা নাড়ছিল বলে ভয়ে কাঠ হয়েছিল শ্যামলেন্দু। তাই ওকে সরিয়ে দিতেই স্বস্তি পেল ছেলেটা। আরও স্বস্তি পেল আমি পেছন ফিরতেই। হাঁফ ছেড়ে তাকাল মোটরের বডির দিকে।
কিন্তু পিছন না ফিরেই দেখলি কী করে?
আয়নার ভেতর দিয়ে।
ঘটাং করে খুলে গেল টিনের ঢাকনি।
ভেতরে কিছু নেই। খালি বাক্স।
.
মুখ কালো হয়ে গেল ইন্দ্রনাথ রুদ্রের। ঈষৎ কুঞ্চিত হল চক্ষুতারকা।
কবিতা ঠাট্টার সুরে বললে–কী ঠাকুরপো, এই নাকি তোমার রহস্যের সমাধান।
চোখ তুলল ইন্দ্রনাথ। চোখ আর স্বপ্নসুন্দর নেই, ইস্পাতকঠিন। গলার স্বরেও শুনলাম রুদ্রকঠোর ডম্বরুধ্বনি–
আমাকেও বোকা বানিয়েছে। ফিরে চল প্রেম। কালো দাগটার মানে জেনে আসি।
কালো দাগ! কীসের?
শ্যামলেন্দুর গালে আর হাতে ভুসোর দাগ দেখিসনি?
দেখেছি। কিন্তু
এই সময়ে গাড়ির পাশ দিয়ে একটি মহীশূরী দম্পতি হেঁটে গেল হাসিতে পথ মুখরিত করে। মেয়েটির খোঁপায় টাটকা ফুলের বেষ্টনী। দেখে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল কবিতা– উটি যাওয়া শিকেয় উঠল। শহরটা অন্তত দেখে আসি। ওগো–
দুষ্ট হাসি ভেসে উঠল ইন্দ্রনাথের পাতলা ঠোঁটের কোণে।
যাও বৎস! বন-বিহার করে এসো।
একটা চলন্ত অটো রিক্সা থামিয়ে গৃহিণীকে নিয়ে আমি রওনা হলাম লালবাগ অভিমুখে।
.
নাটক জমল রুদ্রমূর্তিতে ইন্দ্রনাথের ফিরে আসার পর। পেছনে প্রেমাংশু। বন-বেড়ালের মতো রাগের চোটে যেন ফুলে দ্বিগুণ।
বসবার ঘরে আমাদের উচ্ছিষ্ট না করা ধোসা খাচ্ছিল শ্যামলেন্দু। পাশে বসে গায়ে মাথায় হাত বুলোচ্ছে রাখালরাজ।
হেনকালে মূর্তিমান কালান্তকের মতো আবির্ভূত হল দুই বন্ধু। এবং বজ্রগম্ভীর স্বরে হাঁক দিল ইন্দ্রনাথঃ
শ্যামলেন্দু।
চোখের তারা স্থির হয়ে গেল শ্যামলেন্দুর। স্থির হল রাখালরাজের জিহ্বা।
আপনারা দুজনেই শুনে রাখুন ললিত এখন কোথায়-একটু থেমে–পরলোকে।
অ্যাঁ!
আজ্ঞে হ্যাঁ। ললিত নৃশংসভাবে খুন হয়েছে কাল বিকেলে শ্যামলেন্দুর সঙ্গে দেখা করে যাবার পর। বুঝতেই পারছেন, আইনের চোখে শ্যামলেন্দু এখন এক নম্বর সন্দেহভাজন।
শুধু স্তম্ভিত নয়, অসম্ভব ভয় পেল শ্যামলেন্দু। ভয়ে গা সিঁটিয়ে উঠল। পরমুহূর্তেই হড়হড় করে বমি করে দিল টি-পয়ের ওপরেই।
.
গালের ওপর কালো দাগের রহস্য ফাঁস হয়ে গেল তার পরেই। একইরকম দাগ লেগে শ্যামলেন্দুর হাতে। প্রেমাংশুকে গ্যারেজে টেনে নিয়ে কাঠের আলমারিটা দেখাল ইন্দ্রনাথ। ভূসো লেগে আলমারির পাশের দেওয়ালেও। কেরোসিনের কুপি জ্বালানো হয় নিশ্চয়।
ইন্দ্ৰনাথ দেওয়ালে কপাল ঠেকিয়ে হেঁট হয়ে দৃষ্টি চালনা করল আলমারির পেছনে সঙ্কীর্ণ পরিসরে এবং হাত ঢুকিয়ে টেনে আনল পুরোনো খবরের কাগজে মোড়া একটা ছোট্ট প্যাকেট।
প্যাকেটের মধ্যে পাওয়া গেল তিনটে সমান সাইজের চৌকোনা টিশু পেপার। ঘুড়ির কাগজ বললেও চলে। সাদা।
ঠাসাঠাসি তিন লাইনের একটা সাংকেতিক লিপি লেখা প্রতিটা কাগজে। হরফগুলো দুর্বোধ্য এবং অজ্ঞাত।
.
শ্যামলেন্দু এলিয়ে পড়েছিল সোফার ওপরে। দমদম-দাওয়াই দিয়েও ক্ষান্ত হয়নি ইন্দ্রনাথ। বুলেটবর্ষণের মতো প্রশ্ন নিক্ষেপ করে গিয়েছিল বিরামবিহীন ভাবে।
অসংলগ্ন জবাবগুলো সাজিয়ে নিলে দাঁড়ায় এইঃ
লোহার কোট নামক ডিটেকটিভ ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ললিতমোহন স্বয়ং। এ ক্লাবের মোট সদস্য সংখ্যা পাঁচ। ললিত, শ্যামলেন্দু এবং আরও তিনজন। এক ক্লাসেরই বন্ধু।
কিছুদিন আগে কেম্পেগৌডা টাউনে হঠাৎ খুব চোরের উপদ্রব শুরু হয়। টাউনটা নতুন তৈরি হয়েছে। কোলার স্বর্ণ খনি যাওয়ার পথে পড়ে।
প্রায় প্রতি রাতেই নিশিকুটুম্ব হাজির হতে থাকে গৃহস্থদের বাড়িতে। উত্যক্ত হয়ে বাসিন্দারা পুলিশের শরণ নেয়। পুলিশের ব্যর্থতার পর স্থানীয় ইংরেজি দৈনিক ডেকান হেরাল্ড-এর সম্পাদক গরম গরম সম্পাদকীয় লিখতে শুরু করেন।
ব্যাঙ্গালোর শহরটা আর পাঁচটা শহরের মতো তস্কর-অধ্যুষিত নয়। চোর-ছ্যাচোড় এখানে নেই বললেই চলে। কেম্পেগৌডা টাউনের নিশিকুটুম্ব মহাশয় তাই রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে ওঠে সারা শহরে।
টনক নড়ে ললিতমোহনের। এই সময়ে হিচককের টু ক্যাচ এ থিফ ছায়াছবিটি এসেছিল অ্যাভিনিউ সিনেমায়। ললিত দেখেছিল ছবিটা। তারপরেই জরুরি মিটিং ডাকল লোহার কোট সংঘের।