অন্যমনস্কভাবে ইন্দ্রনাথ বললে–তা ঠিক। শ্যামলেন্দু কোথায়?
এই তো ছিল। আপনাদের দেখেই ভো দৌড় দিল। হাঃ হাঃ হাঃ। সখের গোয়েন্দা মশাই, বুঝলেন কিনা, পুলিশ দেখলেই ভড়কে যায়।
ঠিক বলেছেন, ইন্দ্রনাথের পানে অপাঙ্গে তাকিয়ে মন্তব্য করল প্রেমাংশু। আপনার ছেলেরও গোয়েন্দাগিরির বাতিক আছে নাকি?
হাঃ হাঃ হাঃ! তবে আর বলছি কী! কোথায় গেলি রে শ্যামলা…নাঃ জ্বালালে তো ছেলেটা…গগন…ও গগনচাঁদ, দ্যাখ না বাবা শ্যামলা কোথায় গেল! আপনারা আসুন। কফি খেয়ে যান। ধোসা খান তো? বাড়িতে তৈরি মশায়। উনি নামলেন না গাড়ি থেকে?
শেষ কথাটা নিক্ষিপ্ত হল কবিতাকে উদ্দেশ্য করে।
ওঁর মাথা ধরেছে, বললাম আমি। চলুন এগোই।
এমন সময়ে গগনচাঁদ আবির্ভূত হল আমাদের সামনে। তেল চুকচুকে নধরকান্তি বপু দাদাবাবু গ্যারেজে ঢুকে বসে আছেন। আসবেন না।
দৃষ্টি বিনিময় করল ইন্দ্রনাথ আর প্রেমাংশু।
চলুন, আমরাই যাচ্ছি গ্যারেজে, বলল প্রেমাংশু।
গোলাপি রং করা বাসভবনের পেছনে দুটি ছোট ছোট ঘর। একটিতে গগনচাঁদের সংসার। আর একটিতে একটি শেভ্রলে গাড়ি। ব্লু বডি। নিয়মিত মাজাঘষায় চকচকে। এককোণে একটা কাঠের আলমারি। যন্ত্রপাতি থাকে। দেওয়ালে ভুষো। রাখালরাজ লুঙ্গি খামচে ধরে উধাও হলেন বাড়ির মধ্যে। পুলিশকে খাতির করতে চায় সকলেই।
আমাদের দেখেই গ্যারেজের কোণ থেকে উঠে দাঁড়াল একটি ছেলে। চোখে চশমা। বাপের মতোই গড়ুর নাসিকা। শ্যামলবরণ। গাঢ় নীল রঙের পুলওভারটি বেশ মানিয়েছে ঘন লাল ট্রাউজার্সের ওপর।
ছেলেটির চোখমুখ বুদ্ধিদীপ্ত। কিন্তু ভয়ার্ত। গালে ভুসোর দাগ। হাতেও তাই।
এগিয়ে গিয়ে সস্নেহে বলল ইন্দ্রনাথ–ভয় কীসের শ্যামলেন্দু?
ট্রাউজার্সের দু-পকেটে হাত ঢুকিয়ে জোর করে হেসে বলল শ্যামলেন্দু–না, না, ভয় কীসের। ললিত ফিরেছে?
না। তোমার সঙ্গে ওর দেখা হয়েছিল কখন?
কালকে বিকেলে।
স্কুলে?
স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পর।
কখন?
তখন প্রায় পাঁচটা। সাইকেলে করে এসেছিল, বলে ঢোক গিলল শ্যামলেন্দু।
ও। তারপর?
চলে গেল।
কোথায়?
বলেনি।
তুমি আঁচ করতে পারছ না?
না।
কারও সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল?
জানি না।
কারও সঙ্গে ঝগড়াঝাটি হয়েছিল?
জানি না।
টহল দিতে বেরিয়েছিল কি?
ইয়ে…মানে…।
তুমিও তো ‘লোহার কোট’-এর মেম্বার?
চমকে উঠল শ্যামলেন্দু–আপনি জানলেন কী করে?
আমি জানি। জানাটাই আমার কাজ। তারপর বলল খাটো গলায় আমার নাম ইন্দ্রনাথ রুদ্র।
চশমার আড়ালে জুলজুল করে উঠল শ্যামলেন্দুর দু-চোখ–সত্যি?
সত্যি। এই হল লেখক মৃগাঙ্ক রায়। আর উনি প্রেমাংশু রায়। পুলিশ অফিসার।
প্রেমাংশু তখন ঘুরঘুর করছে গ্যারেজের মধ্যে। যন্ত্রপাতির বাক্স নাড়ছে। গাড়ির তলা দেখছে। শ্যামলেন্দুর ভয়মাখানো চাহনি অনুসরণ করছে তাকে।
চঞ্চল চাহনিটা নজর এড়ায়নি ইন্দ্রনাথের। তাই হঠাৎ বললে প্রেমাংশুকে–প্রেম, তুই বরং রাখালবাবুকে যা জিগ্যেস করবার করে নে। আমি যাচ্ছি।
অর্থপূর্ণ চোখে তাকিয়ে বিনা বাক্যব্যয়ে বেরিয়ে গেল প্রেমাংশু।
একটু সহজ হল শ্যামলেন্দু।
ইন্দ্রনাথ আমাকে ইশারা করতে আমিও বেরিয়ে এলাম বাইরে।
আয়নাটা কার? শুনতে পেলাম ইন্দ্রনাথের প্রশ্ন।
গগনচাঁদের। জবাব দিল শ্যামলেন্দু।
দেখি।
আয়না নিয়ে আলোয় দাঁড়িয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজের মুখখানা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ইন্দ্রনাথ।
তারপর আয়না ঝুলিয়ে রাখল দেওয়ালের পেরেকে।
শ্যামলেন্দু তখনও আড়ষ্টভাবে দাঁড়িয়ে ঘরের কোণে। কাছে গিয়ে কাঁধে এক হাত রেখে স্মিত মুখে বলল ইন্দ্রনাথ–শ্যামলেন্দু?
চোখ তুলে চাইল শ্যামলেন্দু।
ললিত খুব ধাঁধা ভালোবাসে, না?
খু-উ-ব।
প্রেমাংশু এখন নেই। সত্যি করে বলো তো, ওকে দেখে এখানে পালিয়ে এলে কেন?
শ্যামলেন্দু নিরুত্তর।
এক হাত শ্যামলেন্দুর কাঁধে, আরেক হাত শেভ্রলের পেছনের বুটিতে রেখে বললে ইন্দ্রনাথ–আমি বলব?
শ্যামলেন্দুর চোখে এবার শঙ্কার শিহরন।
এক ঝটকায় ঢাকনি তুলে বললে ইন্দ্রনাথ–এই জন্যে।
বলেই, ভেতর থেকে একটা টিনের কৌটো ছোঁ মেরে তুলে নিল ইন্দ্রনাথ।
জিনিসটা একটা টফির বাক্স।