লোহার কোট? খসখস শব্দ স্তব্ধ হতে দেখি লেখা থামিয়ে জুলজুল করে চেয়ে আছে। প্রেমাংশু।
ওর ডিটেকটিভ ক্লাবের নাম। লোহার কোটের মতোই নাকি দুর্ভেদ্য। হাতে লেখা ম্যাগাজিনগুলো দেখবেন?
কই দেখি।
টেবিলের তলা থেকে এক গোছা পত্রিকা বের করে আনলেন বিন্দুমতী। ইন্দ্রনাথের পরিচয় পাওয়ার পর থেকেই ভদ্রমহিলার মধ্যে বেশ চাঞ্চল্য দেখা যাচ্ছে। আমার অস্তিত্ব যেন বিস্মৃত হয়েছেন।
ম্যাগাজিনগুলো চার পৃষ্ঠার চটি ম্যাগাজিন। ডিমাই কাগজে সাইক্লোস্টাইল করা। গোটা গোটা অক্ষরে ওপরে লেখা ও লোহার কোট।
তারপর, পরিচ্ছন্ন হরফে সম্পাদকীয় বিবৃতি, সদস্যদের চিঠিপত্র, টুকরো খবর এবং কিশোর গোয়েন্দাদের সারা মাসের প্রগতি প্রতিবেদন।
ভুরু কুঁচকে শুধোলো ইন্দ্রনাথহাতের লেখাটা কার?
ললিতের।
সুন্দর লেখা। সাইক্লোস্টাইল হত কোথায়?
সিটি মার্কেটের একটা দোকান থেকে।
ম্যাগাজিনগুলো আমি নিয়ে যাচ্ছি–পরে ফেরত দেব। আপনি শ্যামলেন্দুর ঠিকানা জানেন?
জানি।
ঠিকানা লিখে নিয়ে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম সকলে। বিদায় মুহূর্তে দেখলাম, বিষাদ মেঘ ঘনিয়েছে বিন্দুমতীর মুখদেশে। চক্ষু সজল।
বললেন ধরা গলায়–আমি নিয়তি বিশ্বাস করি। যা হবার তা হবেই, কেউ রুখতে পারবে না। ক্ষণজন্মা ললিতকেও যেতে হল সময় ফুরিয়েছিল বলে। কিন্তু
কিন্তু কী? বিরাগপূর্ণ চোখে বলল প্রেমাংশু।
কৌতূহল হচ্ছে, নিমিত্ত হল কোন জন?
কোনও এক নরপশু। নামটা যথাসময়ে জানাব, বলে হনহন করে বেরিয়ে এল প্রেমাংশু।
গাড়িতে উঠে বললে–দ্যাখ ইন্দ্র, খোশামুদ শুনে তুই গলে যেতে পারিস, আমি যাইনি। বিন্দুমতীও ললিতকে খুন করতে পারে।
বলিস কীরে?
ঠিকই বলছি। স্বামী পরিত্যক্তা খাণ্ডারনি তো! তার ওপর ললিত মরলেই পোয়াবারো। মেসোর সম্পত্তিটা হাতানো যাবে।
বিস্ফারিত চোখে কেবল চেয়ে রইল ইন্দ্রনাথ।
তোয়াক্কা না করে প্রেমাংশু বললে–ওই ঋতেশ ছোঁড়াও খুন করতে পারে। অকর্ম করতে গিয়ে ধরা পড়ায়–
প্রেম, ললিতকে হঠাৎ ঝোঁকের মাথায় খুন করা হয়নি। খুন করবে বলেই খুনি ভাঁজ করা তার নিয়ে গিয়েছিল সঙ্গে। ঋতেশ খুনি নয়।
কিন্তু ছুরির কোপগুলো দেখেছিস? এলোপাতাড়ি। রাগের মাথায় ঠিকমতো টিপ করতেও পারেনি। বিন্দুমতীর চেহারাটাও সাংঘাতিক।
হেসে বলল ইন্দ্রনাথবেশ তো, তুই বিন্দুমতী আর ঋতেশকে নিয়ে চিন্তা কর। আপাতত আমাকে নিয়ে চল শ্যামলেন্দুর কাছে।
হঠাৎ বিন্দুমতীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল ফটকের কাছে।
ইন্দ্রনাথবাবু, একটা কথা বলা হয়নি। আপনারাও জিগ্যেস করেননি।
কী বলুন তো?
কবিতার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে নিলেন বিন্দুমতী।
লিলিতের একটা উৎকট হবি ছিল।
কী?
ধাঁধা তৈরি করা।
চোখের সামনে ভেসে উঠল ড্রয়ার ভরতি তারের ধাঁধা!
.
চলন্ত গাড়ির জানলা দিয়ে অন্যমনস্কভাবে ফুটপাতের দিকে চেয়েছিল ইন্দ্রনাথ। হাওয়ায় রেশমমসৃণ চুল উড়ছে। সুন্দর চোখ দুটোর দুপাশ ঈষৎ কুঁচকে রয়েছে। চোখে কুহেলি দৃষ্টি।
কী ভাবছ ঠাকুরপো? ইন্দ্রনাথের গায়ে ঠেলা দিয়ে বলল কবিতা।
অতীত।
হঠাৎ?
বিন্দুমতীর ভাগ্য দেখে।
জিজ্ঞাসু চোখে আমার পানে চাইল কবিতা। সংক্ষেপে বললাম তদন্ত বিবরণ। সবশেষে বললাম–বিন্দুমতী সত্যিই ভাগ্যহীনা। তাই নিয়তিকে আঁকড়ে ধরে বসে আছে।
ইন্দ্রনাথ যেন স্বগতোক্তি করল–ভাগ্য আমারও খারাপ। আমিও জ্ঞান হওয়ার আগেই বাবা-মাকে হারিয়েছি। মাসির কাছে মানুষ হয়েছি। সেই মাসি পরলোকে চম্পট দেওয়ার পর থেকেই আমি বড় একা।
ইন্দ্রনাথের বাল্যকাল আমি জানি। কবিতাও জানে। ওর স্বপ্নিল চাহনির গভীরতা অনুধাবন করতে পারে বলেই অষ্টপ্রহর আগলে রাখে স্নেহ ভালোবাসার তাড়না দিয়ে।
তাই হঠাৎ কোনও কথা খুঁজে পেল না কবিতা। অন্য সময়ে হলে তেড়ে উঠত। এখন বলল ছোট্ট করে–আমরা তো রয়েছি।
কবিতার দিকে ফিরে ম্লান হাসল ইন্দ্রনাথ।
দুর্বোধ্য সেই হাসি। সুগভীর।
বলল–তা আছ।
হা-র-র-উ-ম্! হঠাৎ গলা সাফ করল প্রেমাংশু। অথচ শত চেষ্টাতেও এক ফোঁটা কফও বেরোল না কণ্ঠদেশ থেকে। কিন্তু নিমেষে লঘু হয়ে গেল পরিবেশ। ভুরু কুঁচকে বললে কবিতা– গলায় কী ঢুকল? আরশুলা?
না, ধাঁধা।
রাসেল মার্কেটের সামনে থেকে যে রাস্তাটা ক্যান্টনমেন্টের দিকে গেছে, তার ওপরেই রাখালরাজ সাহার বাড়ি।
ব্যাঙ্গালোরের আরেক নাম গার্ডেন সিটি। বাড়িগুলোই তার চাক্ষুস প্রমাণ। রাখালরাজ সাহার বাড়িও তার ব্যতিক্রম নয়।
মস্ত বাগানে খোন্তা হাতে গোলাপ চারা লাগাচ্ছিলেন রাখালরাজ নিজেই। মাথার সামনে চুল নেই–পেছনে আছে। কপালে তিন ভাঁজ ত্রিবলী রেখা। নাকটি টিয়াপাখির নাকের মতো টিকালো।
গড়ুর নাসিকার ঠিক নীচেই এক জোড়া পুষ্ট গুম্ফ।
খোন্তা নিয়ে দৌড়ে এলেন রাখালরাজ।
আসুন আসুন, কী সৌভাগ্য। লালমোহনের ফোন পেয়েছি। ললিত ফিরেছে? ভদ্রলোকের উল্লাস দেখে প্রথমে ভূ কুঞ্চন করেছিলাম সকলেই। শেষ কথাটা শুনে বুঝলাম, দুঃসংবাদটা জানেন না।
আমরাও জানালাম না।
কোমরের বেল্টটা টেনে তুলতে-তুলতে এগিয়ে গিয়ে প্রেমাংশু বলল–ঘরে চলুন, আপনিই শ্যামলেন্দুর বাবা?
আজ্ঞে, হ্যাঁ। রাখালরাজ সাহা।
ইন্দ্রনাথ গোলাপ দেখছিল তন্ময় হয়ে। স্মৃতির রোমন্থন এখনও যায়নি চোখ থেকে।
সাইজখানা দেখেছেন স্যার? অট্টহাস্য করে বললেন রাখালরাজ। স্খলিত লুঙ্গি বাঁ-হাতে চেপে ধরে খোন্তা দিয়ে গোলাপ দেখিয়ে বললেন–কালচার করা গোলাপ। লালবাগ থেকে কিনেছি। ডালিয়া কি গোলাপে ধরা যায় না।