সে কী ভদ্রমহিলা! নারীত্বের সুষমা কোথাও নেই। মাথায় আমার চাইতেও লম্বা। শুকনো খটখটে। অন্তঃস্রাবী গ্রন্থির গোলমাল আছে মনে হয়। পুরুষ কঠিন মুখাবয়ব, তামাটে রং। প্রেমাংশু অপ্রসন্ন চোখে দেখছিল ভদ্রমহিলাকে। সম্ভবত নিহত ললিতমোহনের সঙ্গে সাদৃশ্য খুঁজছিল, কিন্তু পাচ্ছিল না।
ভদ্রমহিলা হাতজোড় করে নমস্কার করে বসলেন আর একটা চেয়ারে।
বললেন–মাসিমা আর মেসোমশাই দুজনকেই ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। আমি এখনও খাড়া আছি।
থাকাটাই স্বাভাবিক। যা চেহারা–
প্রেমাংশু বললে কাষ্ঠহেসে–এ অবস্থায় আসতে হল শুধু কর্তব্যের খাতিরে। ললিতমোহন আপনার মাসতুতো ভাই?
হ্যাঁ। ছাপাপাড় সাদা শাড়ির খুঁটটা আঙুলে জড়াতে-জড়াতে বললেন হিড়িম্বারূপিণী। আমি স্বামী পরিত্যক্তা, মাসির কাছেই মানুষ! ললিত আমার আপন ভাইয়ের মতো। মাসিমা আমাকে মেয়ের স্থান দিয়েছিলেন। আমার আর কেউ নেই। বাবা-মা গত হয়েছেন।
গলার স্বরে উত্থান-পতন নেই, বিষাদও নেই–নির্বিকার। বাইরের রূপ দেখে বিরূপ মনোভাবের জন্যে ঈষৎ অনুতাপ এল মনে।
প্রেমাংশু নিজেও থিতিয়ে গিয়েছিল বিষণ্ণ বয়ান শুনে। দুঃখে যাদের জীবন গড়া তাদের আবার দুঃখ কীরে? শোকমগ্ন লালমহলে তাই তিনি এখনও নিথর অচঞ্চল।
গলা খাঁকারি দিল ইন্দ্রনাথ–বেশি সময় নেব না আপনার। যে যায় সে ফিরে আসে, কিন্তু তবুও আমাদের কর্তব্য করতে হয়। প্রশ্ন শুরু করি?
করুন। কোলের ওপর দুটি শীর্ণ শিরা বার করা হাত তুলে বসলেন ভদ্রমহিলা। তারপর ধরা গলায় একে-একে অনেক কথাই বললেন, নাম তার বিন্দুমতী। কাজ করেন স্থানীয় টেলিফোন কারখানায়। মেসোমশাই অর্থাৎ লালমোহন পণ্ডিত বিমান কারখানার ডাক্তার। ললিত অত্যন্ত ভালো ছেলে। পড়াশুনায় ভালো, স্বভাবচরিত্রও ভালো। অজাতশত্রু। তা সত্ত্বেও কে তাকে এভাবে খুন করল, সেটাই রহস্য।
গতকাল চারটের সময়ে স্কুল থেকে ফিরেই আবার বেরিয়ে গিয়েছিল ললিত। সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছিল, বলছিল, শ্যামলেন্দুর বাড়ি যাচ্ছি।
শ্যামলেন্দু ওর সহপাঠী। রাসেল মার্কেটের কাছে থাকে। রাত আটটা পর্যন্ত অপেক্ষা করার পরেও যখন সে এল না, তখন মাসি-মেসোকে নিয়ে মালেশ্বরম গিয়েছিলেন বিন্দুমতী বিয়ের নেমন্তন্ন রাখতে। চাকরকে বলেছিলেন, ললিত এসে যেন বিয়েবাড়ি চলে যায়।
কিন্তু ললিত আর আসেনি। আজ ভোরে বাড়ি ফিরেই থানায় ডায়েরি করা হয়। তারপর থেকেই মাসি ফিট হচ্ছেন–মেসো এলিয়ে পড়েছেন।
প্রেমাংশু খাতা বন্ধ করে বললে–ললিতের ঘরটা একবার দেখব।
আসুন। কপালের ওপর থেকে শুকনো চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন বিন্দুমতী। বারান্দার কোণ ঘুরে দাঁড়ালেন একটা দরজার সামনে। হাতকয়েক তফাতে আর একটা দরজা।
বললেন–ওপাশের ঘরটা আমার।
সাদা রং করা পাল্লা খুলে ভেতরে ঢুকলাম। ঘরটা যে আধুনিক ছাত্রের তা এক দর্শনেই মালুম হয়। খবরের কাগজ আর বিভিন্ন সাময়িকপত্র থেকে হরেক রকম ছবি কেটে আঠা দিয়ে লাগানো দেওয়ালে, কিন্তু প্রতিকৃতি কোথাও নেই।
দক্ষিণ দিকের জানলার সামনে কাঠের টেবিলে বইখাতার স্তূপ। পাশের দেওয়াল আলমারিতে ইংরেজি আর বাংলা বই। গল্পের বই বেশি। কয়েকটা বই আমারই লেখা। ইন্দ্রনাথ রুদ্রর কাহিনি। পাশের বইগুলিও ডিটেকটিভ কাহিনি।
দেওয়াল ঘেঁষা সিঙ্গল খাট। মাথার কাছে শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতিকৃতি। পাশেই নিকেল ফ্রেমে বাঁধানো ললিতমোহনের ফোটো। আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসছে। সাদা সার্ট আর শর্ট পরে। ক্রিকেট ব্যাট বগলে দাঁড়িয়ে আছে খেলার মাঠে। চোখ দুটি প্রাণবন্ত। যেন অনুসরণ করছে। আমাদের প্রত্যেককে। নিষ্পাপ চোখে অসীম কৌতূহল।
ইন্দ্রনাথ গম্ভীর হয়ে গিয়েছে ছবিটা দেখে। হেঁট হয়ে টেনে দেখল টেবিলের ড্রয়ার দুটো। ভেতরে একরাশ তারের ধাঁধা।
আমি তর্জনী নির্দেশ করে শুধোলাম–আমার লেখা বই রয়েছে দেখছি।
চকিত চাহনি নিক্ষেপ করলেন বিন্দুমতী–আপনি মৃগাঙ্ক রায়?
হ্যাঁ।
উনিই তাহলে ইন্দ্রনাথ রুদ্র। ললিত আপনার ভীষণ ভক্ত ছিল।
ফিরে চাইল ইন্দ্রনাথ–তাই নাকি?
বইয়ের পোকা ছিল। বিশেষ করে ডিটেকটিভ বই। বলত, বড় হলে ইন্দ্রনাথ রুদ্র হবে। আচ্ছা, হীরামনের হাহাকার-এর ভ্রমর মেয়েটা কি জীবন্ত চরিত্র?
মৃগাঙ্গ বলতে পারে, প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে পালটা প্রশ্ন করল ইন্দ্রনাথ-ললিত সম্বন্ধে একটা কথা জিগ্যেস করতে পারিনি। এখন করছি। ও কি মেয়েদের সঙ্গে মিশতে ভালোবাসত? সোজা কথায় ললিত কি অকালপক্ক ছিল?
না। ঠিক উলটো ছিল। শ্যামলেন্দু ওর প্রাণের বন্ধু। একপাল ছেলে নিয়ে একটা ডিটেকটিভ ক্লাব খুলেছিল। ও ছিল সেক্রেটারি। একটা হাতে লেখা ম্যাগাজিনও বার করত।
বলেন কী! অকপট বিস্ময় প্রকাশ করল ইন্দ্রনাথ। নিবিষ্ট মনে খাতা খুলে নোট নিয়ে চলল প্রেমাংশু।
ললিত বলত, সাহিত্যের স্কুলে পড়ে যেমন সাহিত্যিক হওয়া যায় না, গোয়েন্দা স্কুলে পড়েও তেমনি গোয়েন্দা হওয়া যায় না। দরকার অনুশীলনের। তাই তো সাইকেল নিয়ে টো টো করত সারা শহরে।
কেন?
আপনি নাকি কোথায় লিখেছেন, চোখের ব্যবহার না করলে গোয়েন্দা হওয়া যায় না। ও তাই রাস্তাঘাটে টহল দিত। বলত, এইভাবেই ঘুরতে-ঘুরতে চোর-ঘঁচোড়ের টিকি ধরে ফেলবে। তারপর পুলিশের কাছে খবর পাঠালেই পুলিশ লোহার কোটকে স্বীকৃতি দেবে।