কেন?
যা বলছি, করুন।
বিদ্রোহী ঋতেশ ঘাড় ফেরাল কড়িকাঠের আলোর দিকে। হেঁট হয়ে কী যেন দেখলে ইন্দ্রনাথ। তারপর তর্জনী দিয়ে নাকের নীচে একটা আবছা দাগ দেখিয়ে বললে–বনলক্ষ্মী, বাঁধনছেঁড়া প্রেমের বিপদ অনেক। দাগটা কীসের তোমার বাবা দেখলেই ধরে ফেলবেন।
দাগটা অরেঞ্জ লিপস্টিকের। কিন্তু কিশোরী বনলক্ষ্মীকে অত ভয় দেখানোর দরকার ছিল কি?
ঠিক এই সময়ে পুলিশি জুতোয় ঘর কাঁপিয়ে আবির্ভূত হল প্রেমাংশু–কী হল?
কিচ্ছু না। এদের ছেড়ে দিতে পারিস, লিপস্টিক-রঞ্জিত কাগজ আর পোড়া পানামা একটা খামের মধ্যে রাখতে রাখতে বললে ইন্দ্রনাথ–অভিসার নিয়ে তোর মাথা ঘামানোর সময় নেই।
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ঋতেশ-বনলক্ষ্মীকে নিয়ে উধাও হলেন তিন উদ্বিগ্ন ভদ্রলোক।
প্রেমাংশু হাই তুলে বললে–চল, এবার বাড়ি যাওয়া যাক।
চল।
গাড়িতে উঠে ইন্দ্রনাথকে বললাম–তুই একটা সেক্স-পারভার্ট।
চোখ তুলে ও বলল–সে কীরে।
প্রথম প্রণয়ে অমৃত থাকে। নিজে ব্যাচেলর তো, ঈর্ষার জ্বালায় ঋতেশ-বনলক্ষ্মীর সঙ্গে রুক্ষ ব্যবহার করলি! প্রেম করার সময়ে সবাই সিগারেট খায়।
তাই বল, এতক্ষণে হাঁ বন্ধ করে বলল ইন্দ্রনাথ। মন উচাটন হয়েছে। চল বাড়ি, তোর হচ্ছে।
বাড়ি গিয়েই দরজা ঠেঙিয়ে কবিতাকে ঘুম থেকে তুলল ইন্দ্রনাথ।
বলল সোল্লাসে–বউদি, ঋতেশ-বনলক্ষ্মীর প্রেম দেখে তোমার কথা মনে পড়েছে। মৃগাঙ্কর।
তাই নাকি? এতদিন পরে? চোখ ঘুরিয়ে বলল কবিতা–তোমার মত ভীতু নয়– সাহস আছে।
কার? বলি আমি।
ঋতেশের। পুরো রুপোর টাকা লিখতে হয়েছিল আমাকে কজায় আনতে। মনে পড়ে?
ঋতেশ স্টাইলের প্রেমই কি তুমি চেয়েছিলে? বলগা ছাড়া বাঁধনহারা?
বাহুতে ছোট্ট চড় মেরে কবিতা বললে–মরণ আর কী।
.
সকাল হতেই আলেকজান্ডার চা-জলখাবার নিয়ে হাঁকডাক আরম্ভ করল দোরগোড়ায়।
আলেকজান্ডার প্রেমাংশুর সচিব, সেবাদাস এবং পাঁচক। কানাছেলের নাম পদ্মলোচন। অর্থাৎ, আলেজান্ডারের শৌর্যবীর্য এবং বপু মোটেই ইতিহাসের আলেকজান্ডারের মতো নয়।
এ আলেকজান্ডার কেরালার খ্রিস্টান। টিংটিংয়ে চেহারা। বাড়তি মাংস বা চর্বি কোথাও নেই। হাসতেও জানে না। তবে রাঁধতে জানে।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে চারজনে টেবিলে বসতেই এল গরম গরম ডিমটোস্ট, ওপরে টম্যাটো সস আর চিজ পাউডারের পুরু আস্তরণ। সবে একটা কামড় বসিয়েছি, এমন সময়ে টেলিফোন এল থানা থেকে।
খেতে খেতেই কথা বলে চলল প্রেমাংশু।
কাঁধে জরুলওলা ছেলেটির হদিশ মিলেছে। বসভনগুড়িতে থাকে। নাম, ললিতমোহন পণ্ডিত। পনেরো বছর বয়স। সাইকেল নিয়ে বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিল। আর ফেরেনি। সাইকেলটাও পাওয়া গেছে চন্দন ঝোপের ধারে। ললিতমোহনের আঙুলের ছাপ ছাড়া আর কারও আঙুলের ছাপ সাইকেলে নেই।
রিসিভার রেখে ঘড়ি দেখল প্রেমাংশু। পুরো ডিমটোস্টটা বিশাল মুখগহ্বরে নিক্ষেপ করে বললে জড়িত স্বরে–ঠিক তেরো মিনিটের মধ্যে খাওয়া শেষ করতে হবে। গ্রিনরুম-সাজের জন্যে বউদিকে বাড়তি দু-মিনিট। কুইক বলেই হাত বাড়াল আর একটা টোস্টের দিকে।
.
গাড়িতে বসে কথা হচ্ছিল।
ইন্দ্রনাথ বললে–ব্যাঙ্গালোরে এত বাঙালি আছে জানতাম না।
আমিও জানতাম না সায় দিলাম আমি। মালেশ্বরমে বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন আছে। জানতাম। কিন্তু বসভনগুড়িতে
ইদানীং হয়েছে, বললে প্রেমাংশু। ব্যাঙ্গালোরে মাছ সস্তা, সবজি টাটকা, আর হাওয়া মনোরম। সেই জন্যেই তো শহরটা যাদের, সেই কানাড়াভাষীরাই সংখ্যায় কম এখানে। তামিল ভাষীরাই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। বাঙালিও বিস্তর।
কিন্তু ললিতমোহনের নিখোঁজ হওয়াটা রহস্যময়, বলল ইন্দ্রনাথ। থানায় ডায়েরি হয়েছে কখন?
আজ ভোরের দিকে।
কেন? বিকেল থেকে ছেলে নিখোঁজ, বাপ-মায়ের টনক নড়ল আজ ভোরে।
সেইটাই তো জানতে যাচ্ছি।
ঢেউখেলানো চওড়া রাস্তার দুদিক দিয়ে সাইকেলের সারি। ব্যাঙ্গালোরে বাস কম, ট্যাক্সি আরও কম। স্কুটার রিক্সা আর সাইকেলই এ শহরের প্রধান বাহন।
মন্দির পেরিয়ে মিনিট পাঁচেক যাওয়ার পর জিপ থামল। বাড়িটা সাদা চুনকাম করা। একতলা। সামনে বাগান।
লোহার ফটকের বাঁদিকের থামে লেখা বাড়ির নাম–লালমহল। ডান দিকের থামে প্রস্তরফলকে লেখা গৃহস্বামীর মাম ও ডাঃ লালমোহন পণ্ডিত। ফটকের বাইরে পাহারায় দাঁড়িয়ে দুজন মহীশূরী চৌকিদার। শুঁটকি মাছের মতো শুকনো আকৃতি। দেখে ভক্তি হয় না মোটেই। প্রেমাংশু শালপ্রাংশু বপু নিয়ে নামতেই দুজনেই স্যালুট করল টকাস করে বুট ঠুকে। কবিতা গাড়ি থেকে নামল না।
বলল–শোকতাপের মধ্যে দলবেঁধে যাওয়া মানায় না। তোমরা যাও। কবিতার সূক্ষ্ম অনুভূতিতে যা আগেই ধরা পড়েছিল, বাড়ির ভেতরে পা দিতে না দিতেই তা উপলব্ধি করলাম। একজন আধবুড়ো চাকর এস্তে সরে দাঁড়াল আমাদের দেখে। সারা বাড়ি নিঝুম, থমথমে, শোকস্তব্ধ।
বাড়ির চারিদিকে চওড়া বারান্দা। কেরালা বেতের চেয়ার আর নীচু-টেবিল পাতা।
ইঙ্গিতে চাকরটিকে ডাকল প্রেমাংশুবাবু কোথায়?
এজ্ঞে, ঘুমাইতাছেন।
ঘুমোচ্ছন?
ডাগদারবাবু ছুঁচ ফুড়ে দিলেন যে! বড্ড কাঁদতে ছিলেন।
অ। আর কে আছে বাড়িতে?
দি-মণিকে ডাকব?
ডাকো।
একরকম ছুটেই পালিয়ে গেল প্রৌঢ় ভূত্য।
আমরা বসলাম বেতের চেয়ারে। একটু পরেই একজন ভদ্রমহিলা বারান্দার কোণ ঘুরে দাঁড়ালেন আমাদের সামনে।