জমিটা দেখবি তো? প্রেমাংশু বলল।
বড় টর্চটা দে, ইন্দ্রনাথের কণ্ঠ। ঘাসের ওপর স্বাভাবিকভাবে হাঁটলে পায়ের ছাপ পড়ে না। কিন্তু কেউ যদি পা টিপে টিপে হাঁটে, গোড়ালির ওপর চাপ পড়ে বেশি। কী দেখছিস?
চোখ ফেরালাম। ঘাসের ওপর হুমড়ি খেয়ে রয়েছে ইন্দ্রনাথ। টর্চের মুখ লেগে রয়েছে। ঘাসের ডগায়।
ঘাস দুমড়ে গেছে, তাই তো? রাস্তার দিক থেকে কেউ উঠে এসেছিল দেখছি। ইন্টারেস্টিং। লিখেছিস?
লিখেছি। এবার ওঠ। ডাক্তার এসে গেছে।
ছাগলদাড়ি নেড়ে চত্বরে উঠে এলেন খর্বকায় এক প্রৌঢ়। শীর্ণ মুখ। ব্যাকব্রাশ করা চুল। চোখের কোণে চামড়া কুঁচকোনো।
আলাপ করিয়ে দিল প্রেমাংশু। ডাক্তারের নাম মোতি ডিসিট। খাঁটি কর্ণাটক ব্রাহ্মণ। খুব চটপটে এবং কাজের মানুষ।
শবদেহ ছুঁয়ে বললেন–দেহ তো এখনও গরম দেখছি, বলে ব্যাগ থেকে বার করলেন একটা থার্মোমিটার। ঘাড় মুচড়ে দমবন্ধ করে মারলে অনেকক্ষণ পর্যন্ত দেহ গরম থাকে। মাথায় রক্তক্ষরণ হলেও এমনই অবস্থা দেখা যায়। জেলের মধ্যে একটা মেয়ে গলায় দড়ি দিয়েছিল। তিন ঘণ্টা পরেও থার্মোমিটার লাগিয়ে দেখি একশর ওপর উঠে যাচ্ছে পারদবলতে-বলতে শবদেহ থেকে থার্মোমিটার টেনে বার করলেন ডাক্তার। ব্যাগ থেকে খানিকটা তুলো টেনে নিয়ে থার্মোমিটার মুছলেন এবং তুলে ধরলেন আলোর দিকে।
প্রথম বারো ঘণ্টায় প্রতি ঘণ্টায় দু-ডিগ্রি করে তাপমাত্রা কমে–সেদিক দিয়ে হিসেব সহজ। কিন্তু এ ছোঁড়া তো পড়ে আছে খোলা জায়গায়। ছেলেমানুষ বলেই মাংস পেশির আস্তরণ কম।
অনিমেষে চেয়ে আছে ইন্দ্রনাথ। প্রেমাংশু কানের চুল টানছে নির্মমভাবে।
ডাক্তার বলে চলেছেন–লাশ সরানো হয়েছে। দেখি হাত-পা কত শক্ত…নাঃ, রাইগার দেখে হিসেব করা এখন সম্ভব নয়। একে ছেলেমানুষ, তার ওপরে গা গরম–
এবার ধৈর্যচ্যুতি ঘটল প্রেমাংশুর।
আরে ডাক্তার, আন্দাজেও বলতে পারছেন না কখন মারা গেছে?
কেন পারব না? সন্ধে ছটা নাগাদ। পাঁচটার আগে নয়।
থ্যাংকস।
ডেডবডি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছিলাম বলেই জিনিসটা চোখে পড়ল ঠিক সেই সময়ে।
একটা সাদা বস্তু। ঘাসের মধ্যে পড়ে আছে হাত কয়েক দূরে। সিগারেটের দগ্ধাবশেষ। হাতে তুলে নিলাম। শেষ প্রান্তে পানামা ছাপটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
কমলা রঙের ফিকে দাগটা লেগে রয়েছে তার ওপরেই। লিপস্টিকের দাগ।
অরেঞ্জ লিপস্টিক। আজই কোনও সুন্দরীর অধরোষ্ঠে প্রলেপ দেখেছি। কবিতার ঠোঁটে নয় তো?
না। কবিতার রূপচর্চার তত্ত্ব আমার মাথায় ঢোকে না। ইলেকট্রন মাইক্রোসকোপ দিয়ে নাকি ও দেখিয়ে দিতে পারে, কৃত্রিম প্রসাধন মাত্রই চুল এবং চামড়ার ঔজ্জ্বল্য হরণ করে।
তবে কার ঠোঁটে দেখলাম কমলা আস্তরণ?
সম্বিৎ ফিরল ইন্দ্রনাথের প্রশ্নে–কীরে মৃগাঙ্ক?
পোড়া সিগারেটটা শুধু হাতে তুলে দিলাম। আর কিছু বলতে হল না। শাণিত চোখে বস্তুটা উলটেপালটে দেখে নিয়ে পকেটস্থ করল ইন্দ্রনাথ।
রাত একটার সময়ে ফিরে এলাম থানায়।
.
রাত পেরোতে না পেরোতেই প্রেমাংশুকে ঘেরাও করল তিনজন ভদ্রলোক। উৎকণ্ঠায়, উদ্বেগে তিনজনেই অস্থির।
দীর্ঘদেহী সুপুরুষ ভদ্রলোক বনলক্ষ্মীর পিতৃদেব। সার্কাসের সঙের মতো থমথমে চেহারার ভদ্রলোক ব্যাঙ্গালোর ক্লাবের সেক্রেটারি এবং ক্ষুদ্রাকায় হলেও হাতুড়ি দিয়ে পেটা শরীর যাঁর, তিনি কলকাতা টিমের কোচ।
তিনজনেরই বক্তব্য মোটামুটি একরকম। টেনিস স্টার ঋতেশ রায়ের যশসূর্য কালকের খেলাতেই মধ্যগগনে উঠত কিন্তু পুলিশের উৎপাতে সব পণ্ড হতে বসেছে।
প্রেমাংশু অটল রইল এই হট্টগোলের মধ্যে। আমাকে নিয়ে ইন্দ্ৰনাথ হনহন করে প্রবেশ করল থানাদারের ঘরে। কাঠের পুতুলের মতো বসে আছে ঋতেশ-বনলক্ষ্মী। ঋতেশ ঋজু। বনলক্ষ্মী জবুথবু। মুখ শুকনো। চোখের কোণে কালি।
ইন্দ্রনাথের পায়ের শব্দে মুখ ফিরিয়ে তাকাল ঋতেশ। ভাঙা গলায় বললে–আর কতক্ষণ আটকে রাখবেন? ওঁদের সঙ্গে যেতে দিন।
দেব, মধুক্ষরা কণ্ঠে বলল ইন্দ্রনাথ। তার আগে একটা ছোট্ট পরীক্ষা আছে।
এতক্ষণে নজর পড়ল বনলক্ষ্মীর চারু অধরে। অজন্তা ঠোঁটে অরেঞ্জ প্রলেপ।
দেখেই মনটা দমে গেল। ভেবেছিলাম, হত্যাকারীর সূত্র আবিষ্কার করেছি। কিন্তু তা তো নয়!
ইন্দ্রনাথ চেয়ারে না বসে টেবিলের ওপর কাগজ হাতড়াতে হাতড়াতে বললে– ঋতেশবাবু, সিগারেট খান?
খাই।
আজ সন্ধ্যায় খেয়েছিলেন?
সারাদিনই খাচ্ছি।
ওটা জবাব হল না। সন্ধ্যায় খেয়েছিলেন?
সন্ধ্যায় কখন?
কখন আপনি জানেন না? এবার ঈষৎ কঠিন হল ইন্দ্রনাথের কণ্ঠস্বর। কিন্তু আমি জানি। সাড়ে ছটা। ঠিক?
কী করে জানলেন?
ছ;টায় ছেলেটা মারা গেছে বলে।
সহজভাবেই বলল ইন্দ্রনাথ। কিন্তু ভয় পেয়ে গেল ঋতেশ।
আমি…আমি…।
পানামা সিগারেট, ঠিক?
হ্যাঁ। কিন্তু ইন্দ্রনাথ একটা কাগজ টেনে নিয়ে এসে দাঁড়াল বনলক্ষ্মীর সামনে। বাঁ হাতে মাথাটা কোলের কাছে টেনে নিয়ে ডান হাতে কাগজটা চেপে ধরল অজন্তা ঠোঁটে।
সাদা কাগজে ছাপা হয়ে গেল মিষ্টি ঠোঁটের মিষ্টি ছবি।
কোণ ধরে কাগজটা ঝুলিয়ে ধরল ইন্দ্রনাথ। বলল–বনলক্ষ্মী।
চোখ তুলে চাইল বনলক্ষ্মী। চোখের তারায় ভয়ের কাঁপন।
অল্প লিপস্টিকে মন ওঠে না, তাই না? এত লাগাও কেন?
চুপ করে রইল বনলক্ষ্মী।
ইন্দ্রনাথ এবার ঋতেশকে বললে–মুখটা আলোর দিকে ফেরান।