ঋতেশ?
ধড়মড়িয়ে উঠে ছিটকে গেল বনলক্ষ্মী। নগ্নপদে প্যাট করে বিঁধে গেল একটা নিষ্ঠুর কাটা। ডুকরে উঠে আছড়ে পড়ল নরদেহের ওপর।
ঋতেশ! ঋতেশ! কী হয়েছে তোমার
সাড়া এল পাশ থেকে–আমি এখানে।
রুধিরসিক্ত নরদেহটা ফেলে দিয়ে পিছু হটতে গিয়েছিল ঋতেশ। শেকড়ে পা বেঁধে পড়ে গিয়েছে। আর ওঠেনি। কথাও বলতে পারেনি।
চমকে উঠল বনলক্ষ্মী? কার নগ্নদেহে শুয়ে আছে বনলক্ষ্মী? সারা শরীর ভিজে কেন?
ঘাড় তুলে দেখল বনলক্ষ্মী।
পরক্ষণেই বুকভাঙা চিৎকার করে গড়িয়ে পড়ল ঘাসের ওপর।
প্রেমাংশুর একটা বদভ্যেস আছে। উত্তেজনার কারণ ঘটলেই কানের চুল টানতে থাকে নির্মমভাবে।
সেইভাবেই বললে ইন্দ্রনাথকে–বুঝলি তো? খাঁটি সেক্সমার্ডার। বাচ্চা ছেলে। সারা শরীরটাকে চিরেছে। ঠিক যেভাবে জ্যাক দি রিপার বারবণিতা বধ করত লন্ডন শহরে, যেভাবে কলকাতার রাস্তাঘাটে মেয়েদের পেট আর কোমর চিরে দেওয়া হত কিছুদিন আগেও।
বুঝলাম। এখন কী করবি। রাত কটা বাজল খেয়াল আছে?
দশটা। যাবি নাকি?
কোথায়?
অকুস্থলে।
এরা? ঋতেশ-বনলক্ষ্মীর দিকে চোখের ইশারা করল ইন্দ্রনাথ।
বসে থাকবে। আমি সরেজমিন তদন্ত করে আসার পর ছাড়ব। নটরাজ?
ইয়েস, স্যার। সহকারী থানাদার স্যালুট করে দাঁড়াল চৌকাঠে।
আমি না আসা পর্যন্ত এদের ছাড়বে না। বউদি, তুমি বাড়ি যাও।
কেন? ভ্রূকুটি করল কবিতা।
নৃশংস খুন শোনা যায়, দেখা যায় না। রামনাথ, গাড়ি বার কর।
এদিকে এসো ঠাকুরপো, ইন্দ্রনাথকে বলল কবিতা। একটা কথা বলব।
কী?
চুপিচুপি বলল কবিতা–মেয়েদের অনেক সমস্যা। বনলক্ষ্মীর গায়ের রক্তটার গ্রুপ কি দেখো তো। কৌতূহল হচ্ছে।
কেন বলো তো?
ওর নিজেরও তো হতে পারে।
অকুস্থল।
প্রেমাংশুর ব্যবস্থার ত্রুটি নেই। ফায়ার ব্রিগেড থেকে দুটো পোর্টেবল জেনারেটর এসে গেছে। গাছের ডালে বড় বড় সার্চলাইট বাঁধা হয়েছে। হেভি ডিউটি ইলেকট্রিক কেবল ঘাস। জমির ওপর এলোমেলো ভাবে ছড়ানো রয়েছে।
মাঝের চত্বরে কেউ পা দেয়নি। প্রেমাংশুর নিষেধ আছে।
আমরা তিন বন্ধু জিপ থেকে নামতেই চালু হল জোড়া জেনারেটর। বার কয়েক নিভু নিভু হয়ে জ্বলতে জ্বলতে পুরো তেজে জ্বলে উঠল সার্চলাইটগুলো।
অন্ধকার চন্দনবনে যেন পূর্ণিমা হেসে উঠল মাঝের ঘাস জমিতে। পায়ে-পায়ে আমরা এগিয়ে গেলাম ভূলুণ্ঠিত নরদেহটির দিকে।
ছেলেটি সুদর্শন। ফর্সা, মৃত্যুনীল মুখ। চোখের পাতা খোলা। চাহনিতে জমাট বিস্ময়।
হাঁ করে নিঃশ্বাস নিতে গিয়েছিল মৃত্যুর মুহূর্তে–এখনও দাঁত খিঁচিয়ে আছে–যেন হাসছে।
উলঙ্গ দেহ। হাত এবং পায়ে আড়াআড়িভাবে কোপের চিহ্ন লম্বালম্বি নয়। সবচেয়ে বেশি আক্রোশ ঊরুসন্ধিতে।
পেছনে দু-হাত দিয়ে পলকহীন চোখে চেয়েছিল ইন্দ্রনাথ। ধীরে-ধীরে কঠিন হয়ে উঠল চোয়ালের হাড়। দ্রুত রূপান্তর ঘটছে ইন্দ্রনাথ রুদ্রের। জাগ্রত হচ্ছে বজ্র কঠিন সত্তা।
প্রেমাংশু খাতা-পেনসিল বার করে বলল-ইন্দ্রনাথ, তুই বল। আমি লিখছি।
নতজানু হয়ে ঘাসের ওপর বসে পড়ল ইন্দ্রনাথ।
বলল–মার্জিনে লেখ, এক নম্বর–ডেডবডি। কিশোর। গলায় তারের ফাঁস, পেছনে আটটা মোচড়। ধস্তাধস্তি বা আত্মরক্ষার চোট হাতে পায়ে নেই। হঠাৎ আক্রান্ত হয়েছিল পেছন থেকে। কোপগুলো দেওয়া হয়েছে পরে। তারের বর্ণনা : প্যাকিং বাক্স বাঁধবার দশ গেজ তার। নরম। সহজেই বাঁকানো যায়। মরচে নেই। চার ইঞ্চি অন্তর ভাঁজ করার মোচড়। ভাঁজ করে অকুস্থলে আনা হয়েছিল।
কানে পেনসিল গুঁজে ফস করে একটা পানামা ধরিয়ে নিল প্রেমাংশু। পেনসিল নামিয়ে বললে–দুনম্বর?
চিবুকের তলায় আর চোয়ালের দুপাশের ছাল উঠে গেছে গাছের ঘষটানিতে। গাছের নম্বর লেখক। ক গাছের ছাল এখনও লেগে রয়েছে ছড়া জায়গায়। ঋতেশের বর্ণনার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। লাশকে ক গাছের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল সে চিবুকটা আটকে ছিল দুটো ডালের সন্ধিস্থলে। গাছের তলায় রক্তের পুকুর জমে গেছে ওই কারণেই।
এবার তিন নম্বর সারা গায়ে কোপের দাগ। বাঁ হাতের বাহুমূল থেকে কব্জি পর্যন্ত ছটা কোপ। ডান হাতেও তাই। প্রতিটি ঊরুতে চারটে করে কোপ–পায়ের ডিমেও তাই। কোপগুলো এমন একটা কিছু দিয়ে মারা হয়েছে যার ফলাটা বাঁকা। এলোপাতাড়ি কোপ মারা হয়েছে উরুসন্ধিতে–দেহটা দাঁড় করানো অবস্থায়। খুব সম্ভব এক হাতে চুলের মুঠি ধরে আরেক হাতে কোপ মারা হয়েছে। পাগলের মতো ছুরি মেরেছে বলেই হাত ফসকেছে অনেকবার– ঊরুসন্ধি দ্রষ্টব্য। হত্যাকারী নিঃসন্দেহে যৌন বিকৃতিতে ভুগছে। রক্তপাত ততটা হয়নি। কেন না, কোপগুলো মারা হয়েছে মৃত্যুর পর।
চার নম্বর পিঠ ফালা ফালা করে কাটা। কোনাকুনিভাবে কাটা হয়েছে ঘাড় থেকে কোমরের তলা পর্যন্ত।
পাঁচ নম্বর–ডান কাঁধে জরুল চিহ্ন।
ইন্দ্রনাথের এই রূপান্তর দেখে আজকাল আর অবাক হই না। পরিহাসপ্রিয়, দিলখোলা মানুষটা হঠাৎ পালটে যায়–মুখের হাসি মুছে যায়, চোখের স্বপ্ন ভেসে যায়, কণ্ঠের কৌতুক চলে যায়। তখন ও দুর্জ্ঞেয়, কর্তব্যকঠোর, নীরস।
আমি লেখক মানুষ। নরম ধাতু। রক্ত, বীভৎসতা স্নায়ুর ওপর বড় উৎপীড়ন করে। তাই মুখ ফিরিয়ে চেয়ে রইলাম ঘাস জমির দিকে।
শুনলাম ইন্দ্রনাথ বলছে–গাছের গোড়ায় পড়ে আছে ছেলেটার সাদা শার্ট আর নীল প্যান্ট। পকেটে রয়েছে লাল রুমাল, পেনসিল ইরেজার, চুইংগামের তিনটে মোড়ক, আর একটা পেনসিল কাটা ছুরি।