এবার আমিও ধাঁধায় পড়লাম।
বললাম–না।
ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল ইন্দ্রনাথ। রেলিংয়ে দুহাত রেখে চিন্তাকুল চোখে চেয়ে রইল নীচে।
তখন সন্ধে নামছে। রাস্তায় আলো জ্বলছে।
একটা অটোরিকশা এসে দাঁড়াল দোরগোড়ায়। ভাড়া মিটিয়ে তরতর করে ওপরে উঠে এল বনলক্ষ্মী আর ঋতেশ।
থমকে দাঁড়াল ইন্দ্রনাথকে দেখে। শঙ্কাতুর চাহনি।
ইন্দ্র কিন্তু অন্যমনস্ক। দেখেও দেখল না।
কবিতা এসে হাত ধরে ঋতেশ-বনলক্ষ্মীকে নিয়ে গেল ভেতরে। পাঁচ মিনিট পরে তিনজনেই নেমে গেল রাস্তায়।
ইন্দ্র শুধু চেয়েই রইল। কিছু বলল না।
আমি এসে দাঁড়ালাম পাশে–ইন্দ্র, কফি খাবি?
আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল ইন্দ্র–না। একটু বেরোব।
কোথায়?
কর্নেল হেব্বালের বাড়ি।
কিছু জিগ্যেস করতে?
না। এক হাত তলোয়ার খেলতে। মনটাকে একটু ঘুরিয়ে দিতে চাই চিন্তার ধারা বড্ড এক খাতে বইছে।
চল।
.
নিঝুমভাবে অটোরিকশার কোণে বসে রইল ইন্দ্র।
কেম্পেগৌডা টাউনে যখন ঢুকলাম, তখন চাঁদ উঠেছে। মায়াপুরীর মতো মনে হচ্ছে। হালকা গোলাপি আর সাদা বাড়িগুলোকে।
কর্নেল হেব্বালের ফটক পেরিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। গোলাপ বাগিচায় পায়চারি করছে কেকা।
ও যে এত তাড়াতাড়ি মাইশোর থেকে চলে আসবে ভাবিনি।
চাঁদের ম্লান আলোয় নতমুখী কেকার পানে তাকিয়ে গলা খাঁকারি দিল ইন্দ্রনাথ।
সঙ্গে-সঙ্গে বুঝলাম, ভুল করেছি দুজনেই।
কেকা নয়–কেকার মা। মধুমাধবী।
অপ্রস্তুতের হাসি হাসল ইন্দ্র–মাপ করবেন, কর্নেল আছেন?
নীরব ঘাড় হেলিয়ে সায় দিলেন মধুমাধবী।
খবর দেবেন?
ঘাড় হেলিয়ে ধীর চরণে বাড়ির মধ্যে গেলেন মধুমাধবী। কর্নেল হেব্বাল নিশ্চয় খবর পেয়েই বেরিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু আমাদের দুজনের কাউকেই দেখতে পাননি।
অসভ্যের মতো ইন্দ্রনাথ আমার হাত ধরে ছুটছিল অটোরিকশার সন্ধানে।
.
এক ঘণ্টাও গেল না। দুটো পুলিশ ভ্যান এসে দাঁড়াল কর্নেল হেব্বালের গাড়িবারান্দায়।
আমি আর ইন্দ্রনাথ সটান গেলাম কর্নেলের খোঁজে। প্ৰেম গেল মধুমাধবীর খোঁজে।
তরবারিকক্ষে পায়চারি করছিলেন কর্নেল। চোখে ভ্রূকুটি। আমাদের দেখে থমকে দাঁড়ালেন।
কিন্তু একটি কথাও বললেন না। আরও নিবিড় হল ভ্রূভঙ্গি।
ইন্দ্রনাথ রুদ্রর এ মূর্তি তিনি আগে দেখেননি।
মুখ থেকে হাসি উবে গেছে, মুছে গেছে কৌতুক। স্বপ্নসুন্দর চোখে এখন ঈগল-চাহনি। পাথর মুখে ঝড়ের সংকেত।
দুই হাত পেছনে রেখে বুক চিতিয়ে দাঁড়াল ইন্দ্র। আমি দাঁড়ালাম দোরগোড়ায়।
শুষ্ক কণ্ঠে বলল ইন্দ্র–কর্নেল হেব্বাল, আপনাকে একটা নাটক শোনাতে এসেছি!
কর্নেলের ক্রুর মুখে শুধু একটা কালোছায়া ভেসে গেল। কুঞ্চিত চক্ষুতারকায় যেন হায়নার দৃষ্টি।
হাত পেছনে রেখে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললে ইন্দ্রনারায়ণ সিনয় ভালো ছেলে ছিল না। সে আপনার মেয়ে কেকার ঘরে ঢুকেছিল। কিন্তু কেকা তাকে বার করে দেয়।
কিন্তু এই কেকাকেই গত সাতাশে ডিসেম্বর গভীর রাতে দেখা গেল নারায়ণ সিনয়ের বুকে বসে কিল মারছে। দেখল, ললিতমোহন। ক্ষুদে গোয়েন্দা। চোরের চেহারা দেখবার বাসনা নিয়ে জেদের বশে রোজ রাতে টহল দিত কেম্পেগৌডা টাউনে।
সাতাশে ডিসেম্বর এই বাড়ির উত্তরদিকের কাটাঝোপের একটা ঘুলঘুলি দিয়ে সে দেখতে পেল অদ্ভুত একটা দৃশ্য।
সুইমিং পুলের পাড়ে শুয়ে আছে নারায়ণ সিনয়। কেকা তার বুকে বসে কিল মারছে। আর সিগারেট খাচ্ছে। মারতে মারতে হঠাৎ তাকে গড়িয়ে ফেলে দিলে সুইমিং পুলে।
নারায়ণ ডুবে গেল। কেকা পালিয়ে গেল ভেতরে। ভোর রাতে মৃতদেহ আবিষ্কার করে ঘোর সন্দেহ হল আপনার।
পুলিশ তদন্ত করে গেল। নিছক দুর্ঘটনা। ধামাচাপা পড়ে গেল কেলেঙ্কারি।
আপনিও তাই চেয়েছিলেন। আপনার বংশমর্যাদা জ্ঞান অত্যন্ত প্রখর।
কিন্তু নৈশ কেলেঙ্কারির একমাত্র সাক্ষী ললিতমোহন অস্থির হয়ে রইল সেই থেকে। সুইমিং পুলের পাড় থেকে কেকার ফেলে দেওয়া সিগারেটটা সংগ্রহ করেছিল সেই রাতেই। কুকুরটা বাঁধা ছিল তখন। নইলে ললিতকে ছিঁড়ে ফেলত।
ললিতমোহন গোয়েন্দাগিরি করবে বলে রামকৃষ্ণ আশ্রমে গিয়ে গায়ে পড়ে ভাব করল আপনার মেয়েদের সঙ্গে। শুরু হল এ বাড়িতে যাতায়াত।
তারপর, একদিন কেকা তাকে হাতেনাতে ধরে ফেললে শোবার ঘরে। একটা অরেঞ্জ লিপস্টিক নিয়ে দেখছিল সে।
সুইমিং পুলের পাড় থেকে পাওয়া সিগারেটে অরেঞ্জ লিপস্টিকের দাগ ছিল। কেকার লিপস্টিক।
কেকা তাকে চোটপাট করতেই বাঁকা সুরে ললিত বলে দিলে, সে সব জানে। শুনে শিউরে উঠে কাঁদতে কাঁদতে কেকা গিয়ে নালিশ করল আপনাকে। ললিত নাকি বানিয়ে বানিয়ে নোংরা কথা বলছে।
সতর্ক হলেন আপনি। দূর করে দিলেন ললিতকে বাড়ি থেকে।
কিন্তু ললিত জেদি ছেলে। পুরো একটা মাস কাউকে কিছু বলল না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তদন্ত এগিয়ে নিয়ে চলল। শেষকালে আপনি তার মুখ বন্ধ করার ব্যবস্থা করলেন। সব কথা খুলে বলবার আশ্বাস দিয়ে বললেন, চন্দনবনে যেন সন্ধে ছটায় দেখা করে।
সেইদিন ভোরবেলা কুকুরটাকে বেঁধে রেখে এলেন চন্দনবনে। তারপর ব্রিগেডিয়ার সিংয়ের সঙ্গে পোলো প্র্যাকটিস করতে নামলেন মাঠে। টেনিস ক্লাবের ক্যাপ্টেনও দেখলেন আপনাকে। সাক্ষী রইল দুজন।
হঠাৎ বলটাকে চন্দনবনে ঢুকিয়ে দিয়ে আপনি গেলেন ভেতরে। কাস্তে সঙ্গেই ছিল। কাস্তে নিয়েছিলেন পুলিশকে ঘোল খাওয়ানোর জন্যে। তার-ও ছিল।