পালটা প্রশ্ন করল ইন্দ্রনাথও আক্রমণের ধারা নিয়েছে।
নারায়ণ সিনয় কীভাবে খুন হয়েছে ললিত তা দেখেছিল। কাজটা আপনি ভালো করেননি।
শক্ত মুঠিতে সোফার হাতল খামচে ধরল কেকা। নিরক্ত হয়ে গেল আঙুলের গাঁট। বিস্ফারিত হল চক্ষু।
মিথ্যে কথা! উত্তেজনায় বিকৃত শোনাল কেকাধ্বনি।
আপনার বিছানা থেকে নারায়ণ সিনয়ের মোজা আবিষ্কারটাও কি মিথ্যে? ছেদ নেই ইন্দ্রনাথের আক্রমণে।
নিরুদ্ধ নিঃশ্বাসে চেয়ে রইল কেকা।
পরক্ষণেই দু-হাতে মুখ লুকিয়ে কেঁদে উঠল অঝোর কান্নায়।
নিমেষে খাদে নেমে এল ইন্দ্রনাথের কণ্ঠ। আদ্রর্কণ্ঠে আপন করে নেওয়া সুরে একটির পর একটি প্রশ্ন করে চকিতে পৌঁছে গেল কেকার মনের মণিকোঠায়।
ঘটনাটা এই:
নারায়ণ সিনয় বদ ছেলে। চরিত্রহীন।
কেকার ওপর নজর ছিল প্রথম থেকেই। কিন্তু সুবিধে করে উঠতে পারেনি।
একদিন রাত্রে কিন্তু তার স্পর্ধা চরমে পৌঁছোল। খাওয়াদাওয়ার পর রোজকার মতো বাগানে বেড়িয়ে এসে শোবার ঘরে ঢুকে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল কেকা। বিছানায় শুয়ে নারায়ণ সিনয়। পরনে কেবল জাঙ্গিয়া। চোখে নীরব আমন্ত্রণ। ঠোঁটে কদর্য হাসি। সেদিন আর ধৈর্য রাখতে পারেনি কেকা। চেঁচাতেও পারেনি। মারতে মারতে নারায়ণকে বিতাড়িত করেছিল ঘর থেকে।
হতচকিত নারায়ণ কোনওমতে পাতলুন সার্টটা মাথায় গলিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে চম্পট দিয়েছিল নিজের ঘরে।
পড়েছিল একপাটি মোজা।
বুড়ি দাসী আবিষ্কার করেছিল পরের দিন সকালে।
এই ঘটনার দিন কয়েক পরেই দুর্ঘটনা ঘটল সুইমিং পুলে। ডুবে মারা গেল নারায়ণ সিনয়।
ললিতমোহনের সঙ্গে আলাপ হল সাত আটদিন পর রামকৃষ্ণ মিশনে।
খুব মিশুকে ছেলে। এক রকম গায়ে পড়েই আলাপ করল কেকা আর কলির সঙ্গে। শুরু হল বাড়ি যাতায়াত।
কিন্তু ললিতমোহনকেও একদিন হাতেনাতে ধরে ফেলল কেকা শোবার ঘরে। কেকার প্রসাধন সামগ্রী নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল ললিত।
রেগে গিয়েছিল কেকা। দুটো মিঠেকড়া কথাও শুনিয়েছিল।
ললিতমোহন তখন বাঁকা সুরে বলেছিল–আমি খারাপ ছেলে, না, তুমি খারাপ মেয়ে? গভীর রাতে নারায়ণ সিনয়ের বুকে বসে কিল মারছিলে কেন? সিগারেট খাচ্ছিলে কেন? তুমিই তো ওকে ঠেলে ফেলে দিয়েছ জলে! সব দেখেছি আমি। তোমার বাবাকেও দেখেছি। প্রমাণ। এই লিপস্টিক।
পনেরো বছরের ছেলের মুখে পাকা পাকা কথা আর এক ঝুড়ি কুৎসিত মিথ্যে শুনে বাবার কাছে ছুটে গিয়েছিল কেকা।
কর্নেল হেব্বাল তক্ষুনি ললিতকে বার করে দিয়েছিলেন বাড়ি থেকে।
ললিতের সঙ্গে আর দেখা হয়নি।
.
সব শুনে ইন্দ্রনাথ শুধু একটা কথাই বলল–লিপস্টিকটা কোথায়?
চোখ মুছে উঠে গিয়েছিল কেকা। ক্ষণপরেই এনে দিল স্টেনলেস স্টিলের খাপে মোড়া অধররঞ্জনী। দেখে ভূকুঞ্চণ করলাম আমরা তিনজনেই।
লিপস্টিকটা কমলা রঙের।
.
ফেরার পথে আর একটি কথাও বলল না ইন্দ্র। নিমগ্ন চাহনি দেখে মনে হল যেন অথই জলে হাবুডুবু খাচ্ছে কুল পাচ্ছে না।
আসবার সময়ে হোটেল দশরাজে আকণ্ঠ ইডলি বড়া, রসম-সম্বর খেয়ে নিয়েছিলাম। ইন্দ্রনাথ কিছু মুখে দেয়নি। বিনিদ্র রজনীর পর উৎকণ্ঠাময় ঘটনাপরম্পরায় ওর পাকস্থলী এখন নিষ্ক্রিয়।
ব্যাঙ্গালোরে ফিরলাম বিকেল নাগাদ। ফ্ল্যাটে আমাকে আর ইন্দ্রনাথকে নামিয়ে দিয়ে প্রেম সটান গেল থানায়।
ঘরে ঢুকে গুম হয়ে বসে রইল ইন্দ্র। যেন ভারি গোলমালে পড়েছে।
কবিতা এল। দরজা দিয়ে উঁকি মেরে ওর মুখচ্ছবি দেখে সরে পড়ল নিজের ঘরে।
একটু পরেই এল টেলিফোন। প্রেম ফোন করছে। কোচিং ক্লাসে খোঁজ নেওয়া হয়েছিল। সাতাশে ডিসেম্বরের আগে থেকেই ক্লাসে যাওয়া বন্ধ করেছিল ললিতমোহন।
আটাশে ডিসেম্বর স্কুলে গিয়ে উন্মনা হয়ে বসেছিল লাস্ট বেঞ্চে–যা কখনও বসে না।
রিসিভার রেখে পেছন ফিরতেই দেখি ইন্দ্ৰনাথ দাঁড়িয়ে। চোখে শূন্য দৃষ্টি।
বলল–কোচিং ক্লাসে যায়নি–রোজ টহলে বেরোতো বলে। আটাশে ডিসেম্বর উন্মনা ছিল সকালবেলা খবরের কাগজে উলটো খবর পড়ে। স্বচক্ষে দেখেছে ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছে নারায়ণকে–খবরে ছাপা হল, মামুলি দুর্ঘটনা। বউদি, ঘরে আছ?
ঘর থেকে সাড়া দিল কবিতা–আছি। কিছু বলবে?
হ্যাঁ। কবিতার পাশে গিয়ে বসল ইন্দ্রনাথ। সামনে দাঁড়িয়ে আমি। বলল–বউদি, তুমি নিঃসন্তান। তবুও জিগ্যেস করছি।
লাল হল কবিতার ফর্সা মুখ।
ইন্দ্ৰনাথ দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে বললে–প্রশ্নটা শিশু মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে। ললিতমোহন কিশোর হলেও একটি ব্যাপারে ওর জ্ঞান ছিল শিশুর মতোই। একটু থেমে–ছেলেটা অকালপক্ক ছিল না।
চেয়ে রইল কবিতা। ধরতে পারল না, ইন্দ্রনাথের গোল লেগেছে কোনখানে।
আনমনে বললে ইন্দ্রনারায়ণ সিনয়ের বুকে বসে কেকার কিল মারার অন্য অর্থও যে থাকতে পারে, ললিতমোহন তা ধরতে পারেনি।
অস্ফুট স্বরে বললাম আমি–মাই গড। কানের ডগা পর্যন্ত লাল হয়ে গেল কবিতার।
ঘাড় নেড়ে বলল ইন্দ্র–বউদি, ঠিক কিনা? আদিম মিলনকে মারপিট বলেই মনে হয়েছে ললিতের চোখে?
চোখ নামিয়ে নিয়ে সায় দিল কবিতা।
ইন্দ্রর মনের ধাঁধা কিন্তু কাটল না–সেই জন্যেই কেকা নারায়ণের সিগারেট খেয়েছে, অরেঞ্জ লিপস্টিকের দাগ লেগেছে। সেই কারণেই কেকার অরেঞ্জ লিপস্টিক চুরি করতে গিয়েছিল ললিত। দাগটা মিলিয়ে নেবে বলে। কিন্তু একটু চুপ করে থেকে–মৃগ, কেকা মিথ্যে বলছে। মনে হল কি?