না তো। মাঠেই ছিলেন?
হ্যাঁ। কর্নেল হেব্বাল মাঠের এদিকেই ছিলেন। একবার শুধু বল নিয়ে ছুটে গেলেন চন্দনবনের দিকে।
তারপর?
বলটা বনের ভেতরে ঢুকে গেছিল বোধ হয়। ঘোড়া ছেড়ে দিয়ে ভেতরে ঢুকলেন।
কতক্ষণ পরে বেরোলেন?
কতক্ষণ? পাঁচ মিনিটও নয়। ব্রিগেডিয়ার মদন সিং কর্নেলের নাম ধরে হেঁকে উঠলেন। সেই জন্যেই মনে আছে আমার।
পাঁচ মিনিটের বেশি ভেতরে ছিলেন না?
অতও নয়।
বিকেলে দেখেছিলেন কর্নেলকে?
নিশ্চয়। সাড়ে পাঁচটা থেকে সাড়ে ছটা পর্যন্ত মাঠে ঘোড়া ছুটিয়েছেন।
আচ্ছা নমস্কার।
বিমূঢ় বদনে দাঁড়িয়ে রইলেন সেক্রেটারি।
পোলো গ্রাউন্ডের দিকে পা বাড়িয়ে ইন্দ্র বলল–প্রেম, কী বুঝলি?
কিচ্ছু না।
মূর্খ। আর একটা লাশ পড়েছে।
লাশ!
পাঁচ মিনিটের বেশি চন্দনবনের মধ্যে ছিলেন না কর্নেল। প্রফেসর গোড়বোলে পিঁপড়ে আর শুঁয়োপোকার সূত্র থেকে কী বলেছেন খেয়াল করে দ্যাখ।
ললিত সন্ধ্যায় খুন হয়, সকালেও হত্যাকারী হাজির হয়েছিল সেখানে।
কেন? খুনের মহড়া দিতে নিশ্চয়। রিহার্সাল না দিলে এরকম পরিপাটি খুন সম্ভব না।
ইন্দ্র, তুই কি ওই ভদ্রলোককে খুনি ঠাউরেছিস? অঙ্গুলি সংকেতে ঘোড়সওয়ার কর্নেল হেব্বালকে দেখিয়ে বলল প্রেম।
যুক্তির অঙ্ক তাই বলছে। একটু থেমে–ললিত কাটার জানলা দিয়ে দেখেছিল নারায়ণ সিনয়ের বুকে বসে কিল মারছে কেকা। তারপরেই জলে ঠিকরে গেল নারায়ণ। কে ফেলেছে তাকে? কার ভয়ে সব দেখেও চেঁচিয়ে ওঠেনি ললিত?
কেকার ভয়ে নিশ্চয় নয়।
সহসা শিরপা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল তেজীয়ান ঘোড়া। কদম চালে এগিয়ে এল আগুয়ান দুই মূর্তির পানে।
নিম্নকণ্ঠে বললে ইন্দ্র–প্রেম, ললিত পারিবারিক কেলেংকারির সাক্ষী। নারায়ণ সিনয়ের মৃত্যুদৃশ্যের সাক্ষী। কর্নেল তা জেনেছিলেন। ললিতকে বাজে অছিলায় চন্দনবনে ডেকেছিলেন। সকালবেলা পাঁচ মিনিটের জন্যে বনে ঢুকে রিহার্সাল দিয়েছিলেন কীভাবে খুন করবেন। একটু থেমে–কিন্তু রিহার্সালের লাশটা কোথায় গেল?
জিপ ছুটেছে। এইমাত্র মানডিয়া পেরিয়ে এলাম। লাইন দিয়ে গরুর গাড়ি বোঝাই আখের স্তূপ চলেছে চিনির কলের দিকে।
আত্মগতভাবে ইন্দ্রনাথ বললে–চন্দনবনের খানাখন্দের মধ্যে বাড়তি লাশটা পাওয়া যাবে। তল্লাশের ব্যবস্থা করে এসেছে প্রেম।
রিহার্সালের বলি তাহলে কর্নেলেরই কুকুর? বললাম আমি।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস তাই। সকালের দিকেই নিশ্চয় বেঁধে এসেছিলেন চন্দনবনে। পোষা কুকুরকেই আচমকা খুন করা যায়। গলায় ফাঁস দিয়ে মেরেছেন, কাস্তে দিয়ে কুপিয়েছেন, তারপর কোনও খানায় ফেলে বেরিয়ে এসেছেন পাঁচ মিনিটের মধ্যে। খুব আশ্চর্য কি?
বোবা হয়ে থাকাই শ্রেয় মনে করলাম।
.
মাইশোর সিটি। চামুণ্ডা হিলের শীর্ষে চামুন্ডেশ্বরী মন্দিরের চুড়োয় মেঘের লুকোচুরি।
পাহাড়ের সঙ্গে সমান্তরাল রাস্তার একপাশে মিলিটারি ব্যারাক। শেষ প্রান্তে ললিতামহল– মহারাজার গেস্টহাউস।
অতদূর যেতে হল না। মাঝপথেই একটা প্রকাণ্ড বাড়ি। একতলা। কিন্তু আকার আয়তন। বিশাল।
ফটক পেরিয়ে জিপ ঢুকল ভেতরে। মহীশূরী প্রহরী অভিবাদন জানিয়ে সসম্মানে ভেতরে নিয়ে গেল আমাদের।
সুসজ্জিত বসবার ঘরে আসন গ্রহণ করতে না করতেই গম্ভীর মুখে ঘুরে ঢুকলেন এক বর্ষীয়সী মহিলা। শ্বেতশুভ্র মূর্তি। চুল সাদা, বর্ণ গৌর, বসন শুভ্র।
সৌজন্য বিনিময়ের পর বললেন–আমি কর্নেল হেব্বালের পিসিমা। এখুনি ফোন পেলাম। আপনারা জেরা করতে চান কেকা আর কলিকে?
ভদ্রমহিলা নিঃসন্দেহে মিতবাক।
ইন্দ্রনাথ বললে–আজ্ঞে হ্যাঁ। কলি ওঁর ছোট মেয়ে?
হ্যাঁ।
আগে তাকে পাঠান।
আমার থাকার দরকার আছে?
আপনি তো সবই শুনবেন পরে কেকা আর কলির মুখে।
বেরিয়ে গেলেন মহিলা। আধ মিনিট পরেই ঢুকল ফুটফুটে একটি মেয়ে। বছর দশেক বয়স। পরনে কাচের কাজ করা নীল রেশমের লাহেঙ্গা। জামাটা লাল রেশমের। গৌরবর্ণ, চঞ্চল চাহনি, মৃদুবাক
কর্নেল হেব্বালের মুখাবয়বের সঙ্গে আশ্চর্য সাদৃশ্য।
পাশে বসিয়ে নিমেষে আলাপ জমিয়ে ফেলল ইন্দ্রনাথ।
মিনিট দশেক ধরে কেবল বাজে কথাই বলে গেল। ধীরে ধীর অনাড়ষ্ট হয়ে এল কলি। শিথিল হল মনের আগল।
কথায় কী না হয়। কিন্তু কথার যাদুকর ইন্দ্রনাথ রুদ্রও হার মানল মৃদুবাক মেয়েটির কাছে।
কিছুই জানে না কলি–শুধু দুটি কথা ছাড়া।
দিদির বিছানায় নারায়ণ সিনয়ের এক পাটি মোজা পড়েছিল। সকালবেলা বিছানা ঝাড়তে গিয়ে চোখে পড়ে বুড়ি দাসীর।
আর, দিদিকে ললিতমোহন কী একটা খারাপ কথা বলেছিল। বাবা শুনে রেগে গিয়েছিলেন।
এর পরেই এল কেকা।
কৃষ্ণকায়া, কুচভারনা, ললিতা অলস চাহনি।
স্ফুরিত অধর,–যেন সদা অভিমানিনী।
ঘন চুলের মাঝে সূক্ষ্ম সিঁথি। যৌন-মদির হিল্লোলিত দেহবল্লরী। ষোড়শী।
ক্লান্ত চোখে চেয়ে রইল কেকা–যেন নীল পদ্মের পাঁপড়ি।
বসুন, বলল ইন্দ্রনাথ। বেশিক্ষণ বিরক্ত করব না।
আড়ষ্টভাবে বসল কেকা। বুঝলাম, চাপা ঠোঁটের আগল খুলতে বেগ পেতে হবে ইন্দ্রকে।
ললিতমোহন ছেলে কীরকম ছিল? সটান প্রশ্ন ইন্দ্রনাথের।
ভালো।
জোর করে বলছেন না কেন?
আর কীভাবে বলব?
ললিত আপনাকে একটা নোংরা কথা বলেছিল কী বলেছিল আমি জানি।
নিমর্ম কণ্ঠ ইন্দ্রনাথের।
চমকে উঠল কেকা।
কী বলেছিল? বুঝলাম, এ মেয়ে ভাঙবে তবু মচকাবে না।