কথাটা মনে ধরল ইন্দ্রনাথের–তা ঠিক…তা ঠিক। মৃগাঙ্ক, তোমার পয়েন্ট তুমি পেয়ে গেলে। এবার শুরু করো লেখা। আচ্ছা আসি, কর্নেল। ও হ্যাঁ, একটা কৌতূহল যে এখনও গেল না।
আবার কী?
আপনার ফেন্সিং মাস্টার কে?
এই প্রথম হাসতে দেখলাম কর্নেলকে। বিচিত্র হাসি। যেন পাথর কুঁচকে উঠল ভূগর্ভ আলোড়নে।
বললেন–দেখবেন আসুন।
আমরা তিনজনেই গেলাম পাশের ঘরে। ঘর নয়–হলঘর। একদম ফাঁকা। দেওয়ালে দেওয়ালে রকমারি তরবারি, ঢাল, কুঠার, টাঙি, বর্শা।
ঘরের ঠিক মাঝখানে লোহার বর্মপরা একটি মূর্তি।
মাথায় লোহার শিরস্ত্রাণ। ডান হাতে সুতীক্ষ্ণ তরবারি। মুখে লৌহ মুখোশ।
সুইচ বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে একটা সুইচ টিপে দিলেন কর্নেল। অমনি নড়ে উঠল লৌহমূর্তি। পদযুগল সেঁটে রইল মেঝেতে। চঞ্চল হল উধ্বাঙ্গ এবং ডান হাতের তরবারি।
স্পিংয়ের স্বয়ংচালিত পুতুল। ঠিক অসিযোদ্ধার মতোই অসি ঘুরতে লাগল ডাইনে-বাঁয়ে।
কাঠের র্যাকে সারি-সারি সাজানো তরবারির মধ্যে থেকে একটি বেছে নিলেন কর্নেল। বাঁ-হাত শূন্যে তুলে ডান হাতের তরবারি মিলোলেন লৌহমূর্তির হাতিয়ারে।
মনের চোখে ভেসে উঠল স্ক্যারামুস ছায়াছবি। সেই ক্ষিপ্রতা, সেই পৌরুষ, সেই ঝনকার!
সুইচ টিপে দিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালেন কর্নেল।
পাথর কঠিন হেসে বললেন–আমার আবিষ্কার। প্র্যাকটিস করার দোসর পাওয়া মুশকিল–তাই।
সপ্রশংস চোখে বলল ইন্দ্রনাথ–হাতের কাজ মিটে গেলে এক হাত খেলে যাওয়ার ইচ্ছে রইল।
আপনি? জানেন ফেন্সিং?
সামান্য। কলকাতায় ফ্রেঞ্চ এক্সপার্টের কাছে রপ্ত করেছিলাম কারণ থ্রিল আমার রক্তে। কারণ আমি পেশাদার। তাই বছরে একবারও রিভলভার ছোঁড়ার দরকার না হলেও, রাইফেল ক্লাবে যাই নিয়মিত। জাপানি মাস্টারের কাছে জুডো শিখি, ক্যারাটে মাস্টারের কাছে ক্যারাটে। কারণ আমি প্রফেশন্যাল–অ্যামেচার নই। আচ্ছা, আসি কর্নেল।
ভ্রুকুটি চোখে তাকিয়ে রইলেন কর্নেল হেব্বাল।
নমস্কার জানিয়ে বেরিয়ে এলাম গাড়ি বারান্দায়। জিপের সামনে দাঁড়িয়ে অঙ্গুলি সংকেতে মালিকে ডাকল ইন্দ্রনাথ।
শুধোলো কুকুরটা কোথায়?
মারা গেছে।
কবে?
পরশু।
চলন্ত জিপে প্রথম প্রশ্ন করলাম আমি।
ইন্দ্র, বাড়িতে কুকুর আছে, তা না হয় জেনেছিস ফটকের Beware of Dog বিজ্ঞপ্তি দেখে। কিন্তু এত প্রাণী থাকতে শুধু কুকুরের খোঁজ পড়ল কেন?
স্টিয়ারিংয়ে হাত আর চোখ সামনে রেখে অকস্মাৎ গর্জে উঠল প্রেম–দ্যাট স্কাউন্ডেল কর্নেল
প্রেম, অ্যাকসিডেন্ট করিসনি, বলল ইন্দ্রনাথ। তদন্ত বেশ সন্তোষজনক হয়েছে মনে হল হৃষ্ট স্বর শুনে। মৃগ, তোর কথার জবাব দেব মাইশোর যাওয়ার পথে। তার আগে কাটার জানলাটা দেখে যা।
কাঁটার জানলা!
প্রেম, ওই তো জায়গা..দাঁড়া। কাঁচ করে ব্রেক কষল প্রেম। আমাকে নিয়ে নেমে পড়ল ইন্দ্র।
চওড়া রাস্তা। দূরে দূরে ফিকে গোলাপি আর সাদা রঙের বাড়ি। নবনির্মিত স্যাটেলাইট কলোনি। রাস্তায় পথচারী এবং যানবাহন দুটিই কম।
ফুটপাতের ওপর দিয়ে কাটাঝোপের মানুষ-সমান প্রাচীর। কর্নেল হেব্বালের পুরো বাড়ি ঘিরে রয়েছে এই কাটার প্রাচীর। ইন্দ্রনাথ আমাকে নিয়ে এল এই কাটার দেওয়ালের সামনে।
বলল–আজ সকালে অকারণে হাওয়া খেতে বেরোইনি। টাউন পরিক্রমায় বেরিয়ে কোন ফোকর দিয়ে সুইমিং পুল দেখতে পেয়েছিল ললিত, আবিষ্কার করতে এসেছিলাম।
প্রথমে একটা চক্কর দিলাম। কিন্তু পুরু ঝোপের মধ্যে দিয়ে চোখ চলল না।
তারপর খেয়াল হল, আমি ললিতের চেয়েও লম্বা। ললিতের সমান লম্বা না হলে কাটার জানলা চোখে পড়বে কেন?
তাই মাথা খাটো করে ফের হাঁটতে লাগলাম কাটার দেওয়ালের পাশ দিয়ে।
এইখানে এসে পেলাম জানলাটা। দেখেছিস?
তর্জনী সংকেতে ফোকরটা দেখিয়ে দিল ইন্দ্রনাথ। ছোট্ট একটা ঘুলঘুলি। সদ্য ভাঙা ডাল তখনও পড়ে পায়ের কাছে।
ফোকরে চোখ রাখতেই দেখলাম একটা সবুজ জলাধার। বাঁধানো পাড়। বেশ খানিকটা দূরে যদিও–তাহলেও স্পষ্ট।
.
জিপ ছুটল মাইশোর সিটি-র দিকে।
ইন্দ্রনাথ প্রসন্ন চোখে বাইরে তাকিয়ে বললে–প্রেম, কতক্ষণ লাগবে?
খুব জোর আড়াই ঘণ্টা–আশি মাইল পথ তো।
ইন্দ্র, কুকুরের মৃত্যু নিয়ে তোর টনক নড়ল কেন, এখনও বলিসনি, বললাম আমি। ইন্দ্রনাথ যা বলল, তা এইঃ