সহসা কানে ভেসে এল অসির ঝনঝনানি। ইস্পাতে-ইস্পাতে ঠোকাঠুকির ঝনকার। যেন। স্ফুলিঙ্গ বৃষ্টি হচ্ছে। মরণপণ দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে দুই যোদ্ধা।
না, কল্পনা নয়। সত্যি। পাশের ঘরে বুঝি মহড়া চলছে তরবারি যুদ্ধের।
সন্ত্রস্ত ভৃত্যটি এস্তে অন্তর্হিত হল অন্দরে। ক্ষণপরেই স্তব্ধ হল তরবারির ঝনৎকার। দীর্ঘ পদক্ষেপে জুতো মসমঁসিয়ে ঘরে প্রবেশ করলেন গৃহস্বামী কর্নেল হেব্বাল।
হাতের দস্তানা খুলতে খুলতে পর্যায়ক্রমে চাইলেন আমাদের ত্রিমূর্তির পানে। তীক্ষ্ণ অন্তর্ভেদী দৃষ্টি, শাণিত দৃঢ় চিবুক আর প্রশস্ত চিক্কণ ললাট। প্রখর ব্যক্তিত্ব। পরনে ঘোড়সওয়ারের বেশ। আঁটসাট পাতলুন, পুলওভার।
দস্তানা খোলা হয়ে গেল। ডান হাতে দস্তানা ধরে বাঁ-হাতের তালুতে মৃদু আছাড় মেরে বললেন কুলিশ কঠোর কণ্ঠে–আপনারা দেরি করেছেন।
বসতেও বললেন না। নিজেও বসলেন না। দুপা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে রইলেন প্রকাণ্ড তৈলচিত্রের সামনে।
কাষ্ঠহেসে প্রেম বলল–একটু দেরি হয়েছে।
অনিমেষ রইল মর্মভেদী চাহনি–টিপিক্যাল ইন্ডিয়ান।
অ্যাটিপিক্যাল, মুখ টিপে বলল ইন্দ্রনাথ।
ঈষৎ উত্থিত হল ডানদিকের ভুরু–মানে?
ঠিক উলটো।
কুলিশ কঠোর চাহনি ক্ষণেক স্থির রইল ইন্দ্রনাথের ভাবলেশহীন মুখে।
তারপর-ইনি কে? প্রশ্নটা আমাকে নিয়ে।
আমাদের বন্ধু। লেখক মৃগাঙ্ক রায়।
বসুন, নিজে বসলেন একটা কেদারায়–আমার কাছে কেন এসেছেন? প্রশ্নটা নিক্ষিপ্ত হল প্রেমাংশুর প্রতি উপেক্ষা করা হল ইন্দ্রনাথকে।
ভীম কলেবর নাড়িয়ে সোজা হয়ে বসল প্রেম–ললিতমোহন এ-বাড়িতে আসত। তাই কয়েকটা প্রশ্ন জিগ্যেস করতে চাই।
তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন কর্নেল–দিনকয়েক এসেছিল। তারপর আমি বারণ করে দিয়েছিলাম। বাজে ছেলে।
ললিতের শোচনীয় মৃত্যু আপনার মনে কোনও দাগ কাটেনি দেখছি।
চোখে চোখে চেয়ে রইল প্রেম।
চোখ না সরিয়েই বললেন কর্নেল–বাজে ছেলেকে নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না।
আশ্চর্য! সবাই কিন্তু ওকে হিরের টুকরো বলছে।
আপনার জিজ্ঞাসাগুলো তাদেরকে জিগ্যেস করলেই পারতেন।
রূঢ়কণ্ঠ। কিন্তু তিলমাত্র বিচলিত হল না প্রেম।
আপনি রেগে যাচ্ছেন। ললিত আপনার বিরাগভাজন হল কেন, সেইটাই জানতে চাইছি।
কৃষ্টির অভাব। ওই সোসাইটির ছেলের সঙ্গে আমি আমার মেয়েদের মিশতে দিই না।
ললিত কিন্তু রামকৃষ্ণ আশ্রমে পরিচিত হয়েছিল আপনার স্ত্রী আর মেয়ের সঙ্গে। সেখানে বাজে লোক যায় না।
হতে পারে। কিন্তু ভালো বংশের ছেলে নয়।
শিরায় নীলরক্ত নেই, এই কি তার অপরাধ?
কী বলতে চাইছেন? কড়া গলা কর্নেলের।
আপনি তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন কেন? সমান উষ্ণতা প্রেমের কণ্ঠেও।
আপনার কোনও প্রশ্নের জবাব দিতে রাজি নই আমি। আপনারা আসতে পারেন।
রক্তোচ্ছাস দেখা গেল প্রেমের চোখে। কর্নেল কিন্তু নিথর।
হেসে উঠল ইন্দ্রনাথ–আপনার পারিবারিক ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার কোনও অধিকার আমাদের নেই, কর্নেল। ললিতের সঙ্গে আপনার মেয়েদের গল্পসল্প হত। তাই এসেছিলাম নতুন সূত্রের আশায়।
ছেলেটা অকালপক্ক–এ ছাড়া কিছু বলার নেই।
অকালপক্ক! ভুরু কুঁচকে কী যেন ভাবল ইন্দ্রনাথ। তা হতে পারে। মাইশোরে আপনার মেয়েরা কোথায় উঠেছে?
কেন?
তাদের সঙ্গে কোনও অশোভন আচরণ করা হয়েছিল কি না জানতে চাই।
সেরকম কিছু হলে আমি জানতে পারতাম।
সম্ভব নয়, কর্নেল। মেয়েরা এসব ব্যাপার বাবাকে বলে না।
বাঁ হাতের তালুতে ডান হাতের দস্তানা আছড়ে পড়ল একবার…দুবার..তিনবার।
ধীর কণ্ঠে বললেন কর্নেল–লিখে নিন ঠিকানা। কিন্তু মনে রাখবেন, আমার পারিবারিক সম্মান যেন কোথাও ক্ষুণ্ণ না হয়। পুলিশ আমার মেয়েদের জেরা করুক, আমি তা চাই না। কিন্তু এই একটি কথা জিগ্যেস করলেই যদি এ-বাড়িতে পুলিশের আনাগোনা বন্ধ হয়, তবে তাই হোক।
লাঞ্ছিত মুখে ঠিকানাটা লিখে নিল প্রেম।
কেদারা ছেড়ে উঠি-উঠি করে কর্নেল বললেন–তাহলে?
আর একটা প্রশ্ন, বলল ইন্দ্রনাথ। নারায়ণ সিনয়ের মৃত্যু সম্পর্কে দু-একটা খবর জানতে চাই।
চোখের ভুল কি না জানি না, নিমেষের মধ্যে একটা চাপা উদ্বেগ যেন ভেসে গেল কর্নেলের পাথর কঠিন চোখের তারায়।
বললেন ধীর স্থির কণ্ঠে–তার সঙ্গে এ খুনের কী সম্পর্ক?
কোনও সম্পর্ক নেই। খবরের কাগজে যে খবরটা ছাপা হয়েছিল, তাতে বানান বিভ্রাট ছিল। তাই একটা কৌতূহল মিটিয়ে নেব।
এবার আর ভুল নয়। স্পষ্ট লক্ষ্য করলাম, উদ্বেগের পাষাণটা নিমেষ মধ্যে যেন নেমে গেল কর্নেলের বুক থেকে।
ইন্দ্রনাথ বললে–খবরের কাগজে লিখেছে এ টিপিক্যাল ড্রাউনিং মামুলি জলে ডোবা মৃত্যু। কিন্তু করোনার বলছেন, ওটা হবে অ্যাটিপিক্যাল ড্রাউনিং–অস্বাভাবিকভাবে জলে ডুবে মৃত্যু।
নির্নিমেষে চেয়ে রইলেন কর্নেল।
তফাতটা জানতে এলাম, নিরীহ কণ্ঠ ইন্দ্রনাথের। উত্তেজনার কোনও কারণ ঘটেছিল কি?
উত্তেজনা? নারায়ণ সাঁতার জানত না। সবাই টিটকিরি মারত। তাই বোধহয় রাতবিরেতে একাই সাঁতার শিখতে গিয়েছিল।
একেবারে উলঙ্গ হয়ে? যেন শেলবর্ষণ করল ইন্দ্রনাথ।
থ হয়ে বসে রইলেন কর্নেল।
উঠে পড়ল ইন্দ্রনাথ। গূঢ় হেসে বললে–প্রশ্ন তো সেইখানেই, কর্নেল। সাঁতারের পোশাক না পরে কেউ জলে নামে?
থেমে-থেমে বললেন কর্নেল–মনে রাখবেন, নারায়ণ কানাডায় মানুষ। আমাদের চোখে যা দৃষ্টিকটু, ওদেশে তা আকছার ঘটছে। ন্যুড ক্লাব ওদেশেই সম্ভব–এদেশে নয়।