এগজ্যাক্টলি, সায় দিল ইন্দ্রনাথ।
এবং পাঞ্জাবির পকেট থেকে এক তাড়া কাগজ বার করে বাড়িয়ে দিল–শব্দগুলো সাজিয়ে লিখলে এই দাঁড়ায়–
এক নং টিশু পেপারের সমাধান
Current Issue.
Iron Coat.
দু নং টিশু পেপারের সমাধান
See Quiz.
তিন নং টিশু পেপারের সমাধান
First Word.
Third Live.
সোজা বাংলায়, লোহার কোট ম্যাগাজিনের বর্তমান সংখ্যার ধাঁধা দেখুন। প্রতি তৃতীয় পঙক্তির প্রথম শব্দটি তুলে নিন।
সাবাস! সপ্রশংস চাহনি কবিতার–ম্যাগাজিনটা কোথায়?
এই তো, আরেক পকেট থেকে বেরোল লোহার কোট পত্রিকার চলতি সংখ্যা। কবিতার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললে–জোরে পড়ো।
কবিতা পড়ল। সত্যিই উদ্ভট ছড়া! শিরোনাম–মজার নাচন।
কেকা নাচে কুকুর নাচে নাচেরে বাটপার,
ক্ষিদের জ্বালায় শিশু নাচে নাচে মজুতদার।
হিপির সঙ্গে হিপিনী নাচে খেয়ে ধেনো চোলাই,
ভদ্দর মেয়ে নাচছে পথে।
বলিহারি যাই।
বুকে বসে পুলিশ নাচে লয়ে হাতে ডান্ডা,
ছাত্রছাত্রী নাচছে ক্লাসে
হাতে নিয়ে ঝান্ডা।
বসে বসে নাচে ডাক্তার রুগি অক্কা পেলে,
ভূত নাচে পেতনি নাচে
দল ভারি হলে।
কিল চড় খেয়েও নাচে শুড়িখানার মাতাল,
গরু নাচে মোষ নাচে
প্রমাণ ওই খাটাল।
মারছে সবাই–পাগলা নাচন তবুও নাহি থামে;
ধিন ধিনা ধিন তুনকাতুনা
মুনকামুনা গানে।
প্রোজ্জ্বল চোখে বললে কবিতা–ঠাকুরপো, সমাধানটা আমি বলছি, প্রতি তৃতীয় লাইনের। প্রথম শব্দ তুলে নিচ্ছি। শোনো এবার…
হি-পি-র বুকে বসে কি-ল মা-র-ছে। একটু থেমে–কে কিল মারছে, ঠাকুরপো?
কেকা, দুই চোখে হাসি উপচিয়ে বলল ইন্দ্রনাথ! প্রথম লাইনের প্রথম শব্দটা।
চোখ কুঁচকে চেয়ে রইল কবিতা–ইন্টারেস্টিং! কেকা হি-পি-র বুকে বসে কিল মা-র-ছে! হিপি মানে তো নারায়ণ সিনয়, তাই না ঠাকুরপো? হিপির মতো চুল রাখত?
এগজ্যাক্টলি।
কেকা কার নাম?
বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল ইন্দ্রনাথ–কর্নেল হেব্বালের বড় মেয়ের নাম।
হা-র-র-উ-ম্! চোখ নামিয়ে ঘড়ির দিকে তাকাল প্রেম–দশটা বাজতে চলল। উঠে পড়, ইন্দ্র।
হ্যাঁ, যাই চল।
কোথায় যাবে? বিমূঢ় কণ্ঠ কবিতার। বিমূঢ় আমিও–একেবারে বারহিত।
কর্নেল হেব্বালের বাড়ি। অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।
অ্যাপয়েন্টমেন্ট? কখন হল?
আজ ভোরে। উনি ঘোড়া নিয়ে পোলো প্র্যাকটিস করছিলেন, আমি আর প্রেম হাওয়া খাচ্ছিলাম। আলাপ হয়ে গেল।
হঠাৎ ওখানে হাওয়া খেতে গেলে কেন?
কেন না, চন্দনবন, টেনিস ক্লাব, পোলো গ্রাউন্ড আর কর্নেল হেব্বালের বাড়ি এক লাইনে বলে।
এক লাইনে?
হ্যাঁ। চন্দনবনের একদিকে টেনিস ক্লাব। টেনিস ক্লাবের পাশেই পোলো গ্রাউন্ড। কেম্পেগৌডা টাউন মাইল দুয়েক দূরে–একই লাইনে।
ঠাকুরপো, তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে রইল কবিতা–তুমি কর্নেলকে কী চোখে দেখছ?
হেসে উঠল ইন্দ্রনাথ–প্রেম, পাঁচ মিনিট সময় নিচ্ছি। বউদি শোনো, কেকা কর্নেলের বড় মেয়ে। বাড়িতে কানাডা প্রবাসী হিপি টাইপের অতিথি। হয়ত শ্লীলতাহানি করতে গিয়েছিল। গভীর রাতে। কেকা বাঘিনীর মতো কিল চড় ঘুসি মেরে শুইয়ে দিয়েছিল।
তারপর? সূচী-তীক্ষ্ণ চাহনি কবিতার।
তারপর দুটো সম্ভাবনা থাকছে। মারতে মারতে কেকা হিপিকে ফেলে দিতে পারে সুইমিং পুলে, অথবা কর্নেল হেব্বালের মাথায় খুন চেপে যাওয়ায়–
নিজেই ঠেলে ফেলে দিয়েছিলেন। কেমন?
ফ্যামিলি কেলেঙ্কারী এড়াতে মানুষ সব করতে পারে। বিশেষ করে কর্নেলের মতো মানুষ যিনি বংশমর্যাদা সম্বন্ধে বেশি সচেতন।
ঘড়ি দেখে উঠে পড়ল প্রেম–আর নয়, দেরি হয়ে যাবে।
তুমি কি কেকা-কে জেরা করবে? কবিতাও উঠে দাঁড়াল।
ইন্দ্রনাথ বললে–কেকা বাড়িতেই নেই। মাইশোরে গেছে। কর্নেল দুই মেয়েকেই সরিয়ে দিয়েছেন বাড়ি থেকে।
বলো কী?
কিন্তু আমরা ছাড়ছি না। কর্নেলের সঙ্গে মোলাকাত করেই আমি যাব মাইশোর। ফিরব রাত্রে।
ধড়মড়িয়ে চেয়ার ঠেলে উঠে পড়লাম আমি–ইন্দ্র, আমি যাব।
.
স্টুয়ার্ট গ্র্যাঞ্জারের স্ক্যারামুস দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। দীর্ঘ, দৃপ্ত বপু। তীক্ষ্ণ নাক। কানের ওপর চুলে পাক। পুরুষসিংহ বলতে যা বোঝায়। আকাশের বিদ্যুৎ যেন হাতে পায়ে ভর করে অসিচালনার সময়ে।
সিনেমার স্টুয়ার্ট গ্র্যাঞ্জারকে মূর্ত হতে দেখলাম কর্নেল হেব্বালের মধ্যে। অবিকল সেই চেহারা, সেই ক্ষিপ্রতা, সেই পৌরুষ।
তফাৎ শুধু মুখচ্ছবিতে।
স্টুয়ার্ট গ্র্যাঞ্জার কৌতুকরসে টলমল।
কর্নেল হেব্বাল গম্ভীর, গড়ুর নাসিকায় অসীম ঔদ্ধত্য, চাপা ঠোঁটে নিঃসীম দম্ভ, গ্রানাইট চোখে নীরব নিষ্ঠুরতা।
রোদেপোড়া তামাটে রং। যেন, ব্রোঞ্জ মূর্তি।
চাকরবাকরকে বলে রেখেছিলেন, আমরা এলেই যেন বসবার ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। মস্ত হলঘর। মহার্ঘ আসবাবপত্র। একদিকের দেওয়ালে কড়িকাঠ থেকে মেঝে পর্যন্ত একটা তৈলচিত্র। চওড়ায় পনেরো ফুট, লম্বায় বিশ ফুট। এতবড় অয়েল পেন্টিং শুধু ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলেই দেখেছিলাম।
এক ফুট চওড়া সোনালি ফ্রেমে বাঁধানো তৈলচিত্রের মানুষটি যেন জীবন্ত। অসিচালনায় ব্যস্ত। প্রতিপক্ষের মুখে মুখোশ। কর্নেল হেব্বালের মুখ অনাবৃত। বাঁ হাত শূন্যে উত্থিত। ডান হাতে ঝিকিমিকি তরবারি।
বিমুগ্ধ চোখে চেয়েছিলাম পুরুষসিংহের প্রতি। ভদ্রলোক যে অসিচালনাতে নিপুণ, তা তো জানতাম না।