হা-র-র-উ-ম! বৃংহিত ধ্বনি করল প্রেম।
মনে পড়ে প্রেম কী বলেছিল টিশু পেপারের সাইফার দেখে?
না, কবিতা বললে।
বলেছিল, তামিল, কানাড়া আর মালয়ালম–এই তিনটে দক্ষিণী ভাষার অক্ষর দেখা যাচ্ছে সংকেতলিপির মধ্যে। যেমন, কানাড়া বর্ণমালা থেকে নেওয়া হয়েছে ল আর ব। তামিল থেকে ড আর মালয়ালম থেকে ট৷
আমি বলেছিলাম কিছু ইংরেজি অক্ষরও ওপর-ওপর লেখা হয়েছে, বলল কবিতা। আর আমার কত্তা বলেছিল, হাতে সময় চাই। পরে বলব।
কিন্তু বলেনি। সেই কারণেই বলছিলাম, মেয়েরাই ভালো গোয়েন্দা-লেখিকা হয়–যেমন তুমি।
আমি?
লোকে সন্দেহ করছে, মৃগ-র লেখাগুলো তুমিই লিখে দাও। যেমন ধরো না কেন, টিশু পেপারের সাইফার রহস্য সবাই ভুল করল–তুমি বাদে।
অক্ষরগুলো ইংরেজি?
হ্যাঁ। আমাকে ভুল পথে চালিয়েছে প্রেম ওর স্বল্প জ্ঞান দিয়ে।
হা-র-র-উ-ম!
তুমিই প্রথম আমার মাথায় সূত্রটা ঢুকিয়ে দিলে ইংরেজি অক্ষর। দক্ষিণি হোক, ইংরেজি হোক–অক্ষর। প্রমাণ–একই মাপের আয়তক্ষেত্রের মধ্যে প্রতিটি ইকড়িমিকড়ি ফিট করে যায়।
এ থেকেও প্রমাণিত হল–লিপিটা কোড নয়। কোড হলে হরফগুলো রকমারি সাইজের ছবি হত।
প্রেম আমার সোজা চিন্তাকে ভন্ডুল করে দিল দক্ষিণি অক্ষরের কথা বলে। কাল রাতে তোমরা যখন ঘুমিয়ে কাদা, আমি তখন আলেকজান্ডারকে টেনে তুলেছিলাম। দক্ষিণ ভারতের অনেকেই তামিল, কানাড়া, মালয়ালম, তেলেগু–এই চারটি দক্ষিণী ভাষা রপ্ত করে ফেলে। আলেকজান্ডার তার ব্যতিক্রম নয়।
ওকে আমি বললাম, কানাড়া ভাষায় লি আর ব, তামিল ভাষায় ড আর মালয়ালম ভাষায় ট লিখতে। সাইফার লেখা কাগজ তিনটেও দেখালাম। ঘুমচোখে ও দেখল, কিন্তু লিখে দিল। সে লেখা দেখে চোখ খুলল আমার এবং বুঝলাম প্রেম একটা।
কী লিখল, তাই বল। কবিতা বললে রুদ্ধশ্বাসে।
আলেকজান্ডার চারটে ইংরেজি অক্ষর লিখে দিয়ে ঘুমোতে চলে গেল।
আবার ঘর নিস্তব্ধ। প্রেম শিবনেত্র। কবিতার ললাট কুঞ্চিত। আমি হতচকিত। ইন্দ্রনাথ পা নাচাতে নাচাতে বললে-বন্ধুগণ, কানাড়ায় ল মানে ইংরেজি C, ব মানে W, তামিল ড হল ইংরেজি L, আর মালয়ালম ট হল ইংরেজি S।
ঘুরেফিরে তাহলে বউদির সিদ্ধান্তেই আসতে হল। অক্ষরগুলো ইংরেজি। কিন্তু সাদৃশ্য আছে দক্ষিণি হরফের সঙ্গে।
টিশু পেপার তিনটে জোর আলোর নীচে রেখে ফের দেখলাম, পেনসিলের দাগ, কাগজ ফুঁড়ে বেরোয়নি, পেছনেও উঁচু-উঁচু হয়নি। অর্থাৎ পাতলা কাগজটাকে হয় টিন, না হয় প্লাস্টিকের ওপর রেখে লেখা হয়েছিল।
ললিতমোহনের ঘরের প্রতিটি বস্তু চোখের সামনে ভেসে উঠল। টিন বা প্লাস্টিক বা ওই জাতীয় মসৃণ, কঠিন বস্তু দেখেছি বলে মনে পড়ল না।
অথচ আমরা জানি, রোববার ওই দৃশ্য দেখে বাড়ি ফেরার পর রাত জেগে ঘরের মধ্যেই ধাঁধা রচনা করেছে ললিত।
অন্যমনস্কভাবে চুইংগামের মোড়ক আর টিশু-পেপারগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করছি, এমন সময়ে লক্ষ্য করলাম, মোড়কের যা সাইজ, টিশু পেপারেরও সেই সাইজ।
বুকের রক্ত ছলকে উঠল। ওপর-ওপর রাখতেই বুঝলাম, টিশু-পেপার মোড়কের ভেতরেই ছিল। চুংগাম প্যাক করার রীতিই তাই।
মোড়কের সঙ্গে পাতলা কাগজ মিলিয়ে রাখতে গিয়ে দেখলাম, অধস্বচ্ছ টিশু-পেপারের মধ্যে দিয়ে মোড়কের লেখা দেখা যাচ্ছে। লেখাটা ইংরেজি।
এবং অক্ষরগুলো পাতলা কাগজের ওপর পেনসিলে লেখা অক্ষরের মাপের।
পাতলা কাগজ সরিয়ে নিলাম। দেখলাম, মোড়কের পেছনে একটা মজার ছড়া লেখা। আবোল তাবোল ইংরেজি ছড়া।
আমার বুকের মধ্যে ঢেঁকির পাড় পড়তে লাগল। পাতলা কাগজটাকে ট্রেসিং পেপার হিসেবে ব্যবহার করা হয়নি তো?
আবার কাগজটাকে রাখলাম মোড়কের ওপর। স্পষ্ট দেখতে পেলাম না। আলোর সামনে তুলে ধরলাম। দেখলাম একই মাপের হরফ।
কিন্তু শূন্যে তুলে ধরে কপি করি কী করে?
ললিতমোহনও নিশ্চয় একই সমস্যায় পড়েছিল। কপি করেছিল কী করে?
ললিতের ঘরটা ফের চোখের সামনে ভেসে উঠল। শোবার ঘরের পাশেই রাস্তা। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলো জানলার কাঁচে পড়ে। ট্রেস করার উপযুক্ত ব্যবস্থা। কাচের ওপর কাগজ রেখে পেনসিল দিয়ে কপি করা কি কিছু কঠিন?
একটার পর একটা আবিষ্কার রেস-হর্সের মতো ছুটতে লাগল মাথার মধ্যে দিয়ে। শক্ত, নিরেট মসৃণ বস্তুটা তাহলে জানলার কাঁচ। গুড।
আমি আলোর সামনে রেখে মোড়কের হরফের সঙ্গে পাতলা কাগজের হিজিবিজি হরফগুলো মিলিয়ে দেখতে লাগলাম। সময় লাগল অনেক। কিন্তু সমাধান এসে গেল হাতে।
থামল ইন্দ্রনাথ। তাকিয়ে দেখি, কবিতার নাসারন্ধ্র স্ফীত। দুই ভুরুর মাঝে সমান্তরাল দাঁড়ি। এক কথায়, চূড়ান্ত তন্ময়তা।
বউদি, বলল ইন্দ্রনাথ। ললিত সত্যিই ভালো গোয়েন্দা হতে পারত। ক্ষণজন্মা ছেলে। উদ্ভট ইংরেজি ছড়ার কতকগুলো শব্দের শুধু প্রথম অক্ষরটাও ইচ্ছে করেই জড়িয়ে মড়িয়ে কপি করেছে পাতলা কাগজে। লেখা আছে কয়েকটি অক্ষর।
বীজগণিতের ফর্মুলা মনে হচ্ছে, মন্তব্য করলাম আমি।
মনে করানোর জন্যেই ওইভাবে লেখা হয়েছিল, এমনও তো হতে পারে? প্রতিবাদ জানাল কবিতা।
উষ্ণকণ্ঠে বললাম–তাই নাকি?
আমার উষ্মা উপভোগ করল ইন্দ্রনাথ। বলল হৃষ্টকণ্ঠে বন্ধুবর মৃগাঙ্ক, বউদি ঠিকই বলেছে। ওটা বীজগণিতের অঙ্ক নয়।
কবিতা বললে–শুনতে পেলে না ঠাকুরপো কী বলল? ইংরেজি ছড়ার কতকগুলো শব্দের প্রথম অক্ষরগুলো শুধু কপি করেছে ললিতমোহন। তার মানে কি এই নয় যে, প্রত্যেক অক্ষরের সঙ্গে লাগোয়া পুরো শব্দটা বেছে নিলেই ধাঁধার জবাব মিলবে?