ঋতেশ রায় ছেলেটির কাধ ধরেছিল। ফলে লাশটা ওদের ওপর এসে পড়ে। জামা কাপড়ে রক্ত লেগেছে সেই কারণেই।
এই দেখেই দুজনে দৌড়োতে-দৌড়োতে থানায় এসে খবর দিয়েছে আমাকে। কিন্তু বলে থামল প্রেমাংশু।
এই সময়ে আমার চোখ পড়ল ইন্দ্রনাথের পানে। কবি কবি চোখে ওমর খৈয়ামের স্বপ্ন ভাসিয়ে ও অপলকে চেয়ে আছে বনলক্ষ্মীর প্রায় অনাবৃত পিঠের দিকে।
দুই চোখে নীরব ভৎর্সনা নিয়ে কবিতাও দেখছিল ইন্দ্রনাথের কাণ্ড। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই যেন নির্ভাষ টেলিপ্যাথি দিয়ে বললে?
এই জন্যেই বলেছিলাম ঠাকুরপোর বিয়ে দাও।
প্রেমাংশু কিন্তু বলে থামতেই সম্বিৎ ফিরল ইন্দ্রনাথের।
স্বপ্ন-সুন্দর চোখে তাকিয়ে বললে–কিন্তু কী?
জায়গাটা শহরের বাইরে। সব চন্দন খেতই শহরের বাইরে। কিন্তু শহর দেখানোর জন্যে ওখানে যাওয়া হয়েছিল কেন?
ঘর নিস্তব্ধ। ঋতেশ রায়ের বড় বড় চোখে শুধু বিদ্রোহ নয়, এবার খানিকটা ভয়ও জাগ্রত হল।
আরও আড়ষ্ট হল বনলক্ষ্মী।
খুব মৃদু মসৃণ কণ্ঠে বললে ইন্দ্রনাথ–প্রশ্ন আরও আছে।
কী?
ঋতেশবাবু–
উচ্চৈঃশ্রবার মতো ঘাড় বেঁকিয়ে তাকাল ঋতেশ। তেজি ছেলে। বেকায়দায় পড়ে বোবা হয়ে রয়েছে। নইলে
ইন্দ্রনাথ স্মিতমুখে বললে–আপনারা চন্দন খেত দেখতে গিয়েছিলেন, তাই না?
ঢোঁক গিলে বললে ঋতেশ–হ্যাঁ।
বনলক্ষ্মী? তুমিও?
জবুথবু বনলক্ষ্মী চমকে উঠল প্রশ্ন শুনে। ত্ৰাসকম্পিত চোখে শুধু ঘাড় নাড়ল।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ইন্দ্রনাথ। বনলক্ষ্মীর পেছনে দাঁড়িয়ে বললে–মিথ্যে কথা।
বিবর্ণ হয়ে গেল বনলক্ষ্মী।
তর্জনী দিয়ে বনলক্ষ্মীর পিঠ দেখিয়ে বলল ইন্দ্র : প্রেম, দাগটা তোর আগেই দেখা উচিত ছিল।
দাগ? উঠে এল প্রেমাংশু। তাই বল। রক্তের দাগ। লাগবেই তো। লাশটা যে ঘাড়ের ওপর পড়েছিল।
কিন্তু আমি বুঝলাম, কেন এতক্ষণ নির্লজ্জভাবে বনলক্ষ্মীর পিঠ দেখছিল ইন্দ্রনাথ।
দাগটা রক্তের সন্দেহ নেই। কিন্তু তার আধখানা জেগে রয়েছে ফর্সা চামড়ার ওপর, বাকি আধখানা ঢাক পড়েছে গোলাপি ব্লাউজের তলায়।
মানেটা অতি সুস্পষ্ট।
প্রেমাংশু থানাদার হলেও চিরকুমার। তাই বোধহয় একটু বুঝতে সময় লাগল। সত্যটা হৃদয়ঙ্গম হতেই হুংকার ছাড়ল বাজখাই গলায়? তাই ত বলি, সন্ধের সময়ে ঝুপসি জায়গায় যাওয়া কেন– হাতের ইঙ্গিতে থামিয়ে দিল ইন্দ্রনাথ।
বলল রেশমকোমল কণ্ঠে–বনলক্ষ্মী।
মুখ তুলে চাইল বনলক্ষ্মী। গোল ফর্সা মুখটা ভয়েলজ্জায় শুকিয়ে গেছে।
আমি পুলিশ নই। আমার নাম ইন্দ্রনাথ রুদ্র।
কেঁপে উঠল বনলক্ষ্মীর চক্ষুপল্লব। ঈষৎ বিস্ফারিত হল চক্ষুতারকা।
চিনতে পেরেছ? একটু-আধটু গোয়েন্দাগিরি করি। এই আমার জীবনীকার মৃগাঙ্ক রায়। আর এই হল মৃগাঙ্কর গৃহলক্ষ্মী–তোমাদের কবিতা বউদি।
একটু থেমে ফের বললে ইন্দ্রনাথ–এ ঘরের পাশে একটা ঘর আছে। সে ঘরে জানলা নেই। কেউ আড়ি পাতবে না। কবিতা বউদির সঙ্গে ওই ঘরে যাও সব কথা বলো। গোপন করবে না, কেমন?
বনলক্ষ্মী– চেয়ার ছেড়ে উঠতে গেল ঋতেশ।
ইন্দ্রনাথ কাধ ধরে ফের তাকে বসিয়ে দিলে চেয়ারে।
বলল–আপনার জামা খুলুন। কোথায় কোথায় রক্ত লেগেছে দেখান।বউদি?
কবিতাকে আর কিছু বলতে হল না। উঠে দাঁড়িয়ে সস্নেহে বনলক্ষ্মীর বাহু ধরে নিয়ে গেল পাশের ঘরে।
বেরিয়ে এল দশ মিনিট পরে। যা বলল, তা এই ও
.
তখন গোধূলি। রক্তসন্ধ্যার মুহূর্ত।
গাছে-গাছে পাখির কলরব থেমে আসছে। কিন্তু অন্ধকারের যবনিকা নামতে এখনও অনেক দেরি।
নিঝুম বনতলে মুখ হেঁট করে বসে বনলক্ষ্মী। পাশে ঋতেশ।
বাঁ-হাতের তর্জনী দিয়ে ঘাসের ওপর আলপনা আঁকছে বনলক্ষ্মী।
লজ্জায় আয়ত চোখ তুলে তাকাতেও পারছে না।
কানের কাছে ভ্রমর গুঞ্জনের মতো গুনগুনিয়ে চলেছে ঋতেশ।
বনলক্ষ্মী–
তোমার বাবা রাজি হবে?
ধেৎ।
বলব?
জানি না।
আজ কিন্তু আমাদের শুভদৃষ্টি।
অসভ্য।
শুনছ না পাখিরা মন্ত্র পড়ছে? বিয়ের মন্ত্র। চন্দনবনে আজ আমাদের বিয়ে।
তারপর? অপাঙ্গে তাকাল বনলক্ষ্মী।
বাসরঘর। বলে, আলতো করে ঠেলে বনলক্ষ্মীকে শুইয়ে দিল ঋতেশ। নিজেও শুয়ে পড়ল পাশে।
.
বনলক্ষ্মীর কপালে চিবুক রেখে সামনে দৃষ্টি প্রসারিত করল ঋতেশ। শরীরের প্রতিটি অণুপরমাণুতে তখন অসীম অবসাদ, নিঃসীম আবেশ আর অননুভূত আনন্দ।
ঠিক এই সময়ে তৃণভূমির কিনারায় চন্দন শাখার সন্ধিস্থলে একটি মুণ্ড দেখা গেল। দাঁত বের করে হাসছে একটি ছেলে।
চক্ষের পলকে শরীরের সমস্ত রক্ত যেন ধেয়ে গেল মস্তিষ্কের কোষে কোষে। রাগে অন্ধ হয়ে সামনে ছিটকে গেল ঋতেশ। বাঁ-হাতে ছেলেটার মুঠি ধরে ডান হাত তুলল শূন্যে।
ভয়ংকর দৃশ্যটা চোখে পড়ল তখনই। শিথিল মুষ্টি থেকে খসে গেল মুণ্ড–উলঙ্গ লাশটা লুটিয়ে পড়ল ঘাসের ওপর।
বনলক্ষ্মী শঙ্কিত হয়েছিল ঋতেশের অকস্মাৎ লাফিয়ে ওঠা দেখে। তনু-মনের অণুপরামাণুতে যখন ভূপালি রাগিণীর উচ্ছ্বাস, ঠিক তখনি শ্লথ বাহুপাশ থেকে জ্যামুক্ত তীরের মতো ছিটকে বেরিয়ে যাওয়াটা–আচম্বিতে একটা ঝপ শব্দ ভেসে এল কানে। তারপর সব নিস্তব্ধ।
ঋতেশ?
কোনও সাড়া নেই।
ঘাসের কার্পেটে গড়িয়ে গিয়ে কনুইয়ে ভর দিয়ে উধ্বাঙ্গ তুলে শব্দের উৎস অন্বেষণ করল বনলক্ষ্মী।
দেখল, একটা নরদেহ ঘাড় মুচড়ে ভূমিশয্যায় শয়ান। ভঙ্গিমাটা অস্বাভাবিক। আকাশের আলো তখন ক্ষীণ। এর বেশি দেখা গেল না।