ললিতমোহনের পকেটের ফরেনসিক রিপোর্ট পড়তেই অন্ধকারে আলো দেখলাম। পকেটে পোড়া সিগারেটের তামাক পাওয়া গেছে। একই তামাক।
বউদি, কফিতে এতক্ষণে চুমুক দিয়ে বলল ইন্দ্রনাথ, বলো দিকি এ থেকে কী সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত?
পোড়া সিগারেট ললিতের পকেটে ছিল। হত্যাকারী আসার আগেই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে।
ব্র্যাভো, মাই ডিয়ার বউদি। এইজন্যেই যুগে-যুগে মেয়েরাই ভালো গোয়েন্দা গল্প লিখছেন। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে সিগারেটটা এতদিন পকেটে রেখে দেবার পর ছুঁড়ে ফেলে দিল কেন?
স্ত্রীর প্রশংসায় আহত কণ্ঠে আমি বললাম হত্যাকারীর হাতে সূত্র দিতে চায়নি বলে।
কিন্তু মৃগ, ললিত জানত না ও খুন হতে চলেছে। ও এসেছিল অ্যাপয়েন্টমেন্ট মত। কেম্পেগৌড়া টাউনের নিশীথ রহস্য শুনতে। রহস্যের নায়ক স্বয়ং যখন হাজির হচ্ছে, তখন পোড়া সিগারেটের সূত্র রেখে আর লাভ কী, এই ভেবেই হয়ত ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল হত্যাকারীর প্রতীক্ষার উশখুশ করার সময়ে। যুক্তিযুক্ত?
মুখ গোঁজ করে রইলাম আমি। শিবনেত্র হয়ে রইল প্রেম। অপাঙ্গে আমার অবস্থা অবলোকন করে হৃষ্টকণ্ঠে কবিতা বলল–কারেক্ট।
ইন্দ্রনাথ বললে–এবারে এসো আসল প্রশ্নে। তুমি কিন্তু এখনও জানো না, পোড়া সিগারেটটা কার এবং ললিত পেল কোথায়।
নারায়ণ সিনয়ের সিগারেট নয় তো? তীব্র সন্দেহটা আচমকা আলোকসম্পাত করল। আমার মস্তিষ্ক-গগনে।
এই তো ব্রেন খুলছে, টিটকিরি দিল ইন্দ্রনাথ। তবে এখনও পুরো খোলেনি। তুই প্রেমাংশুর কথাটাই পুনরাবৃত্তি করলি। চৌবাচ্চার পাড়ে রাখা অ্যাশট্রেতে সিগারেটের ছাই ছিল– কিন্তু সিগারেট ছিল না।
হা-র-র-উ-ম্। গলা সাফ করল প্রেম।
ঠোঁট বেঁকিয়ে কবিতা বললে–কফি খেলেই তো হয়। তারপর?
নারায়ণ সিনয়কে অস্বাভাবিকভাবে মরতে দেখেছে ললিত। মনে রেখো, নিছক জলেডোবা মৃত্যু নয়–অস্বাভাবিক মৃত্যু।
মনে আছে। তারপর?
তার মানে কি এই নয় যে, অকুস্থলে নারায়ণ ছাড়াও আরও একজন ছিল? এমন একজন ছিল যাকে দেখে চুপ করে থেকেছে, নইলে নিশ্চয় চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করত?
চোখ কুঁচকে রইল কবিতা। এমনকী আমিও ক্ষোভ ভুলে চনমনে হলাম। সাসপেন্সের কী মহিমা!
ইন্দ্রনাথ কফি না খেয়েই বলে চলল–নারায়ণের পোড়া সিগারেট নিয়ে ললিতের লাভ কী? নিজেকে যে হবু গোয়েন্দা মনে করে, সে তো হত্যাকারীর সূত্রই পকেটস্থ করার চেষ্টা করবে। বন্ধুগণ, পোড়া সিগারেটটা তাহলে কার?
হত্যাকারীর। ঊর্ধ্বনেত্র হয়ে বলল প্রেম।
এক চুমুকে উত্তাপহীন কফি নিঃশেষিত করে ঠন করে কাপ নামিয়ে রাখল ইন্দ্রনাথ।
বলল–গুড পয়েন্ট। পোড়া সিগারেট তাহলে হত্যাকারীর। সে শুধু সিগারেটই খায় না, তাতে অরেঞ্জ লিপস্টিকও লেগে থাকে। পয়েন্টটা খেয়াল রেখ বউদি। বনলক্ষ্মীর ঠোঁটেও অরেঞ্জ লিপস্টিক ছিল।
প্রখর হল কবিতার হরিণী চক্ষু।
ইন্দ্রনাথ বলল, তোমরা এখনও জানো না, কাল রাতেই কেম্পেগৌডা টাউনের চোর ধরা পড়েছে। অপরাধও স্বীকার করেছে। সে ছিঁচকে চোর-খুন করা তার ঠিকুজিতে নেই। সব ক্রিমিন্যালেরই কাজের নিজস্ব ধারা আছে।
মনুষ্যচরিত্র অতীব বিচিত্র, মন্তব্য করলাম আমি।
বুঝলাম। অর্থাৎ চোরও খুন করতে পারে। নারায়ণ সিনয় হয়ত দেখে ফেলেছিল– তাই তাকে ধাক্কা মেরে জলে ফেলে সে চম্পট দিয়েছে। প্রথমে আমিও তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম, পালাবার জন্যেই যে ধাক্কা মারবে সিনয়কে, সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে যাবে কেন?
রাইট, প্রেমের মন্তব্য।
সবচেয়ে বড় প্রমাণ, চোরমহাশয় মাইশোর বিড়ির ভক্ত সিগারেটের নয়। বন্ধুগণ, চোরকে সম্ভাব্য খুনির আওতা থেকে বাদ দিতে পারি?
স্বচ্ছন্দে, রায় দিল কবিতা।
এবার দুনম্বর বস্তুর বিশ্লেষণ, চেয়ারের পেছনে মাথা ছেড়ে দিয়ে টেবিলের তলায় পা দুটো টান টান করে ছড়িয়ে দিল ইন্দ্রনাথ–চুইংগামের মোড়ক।
ঘর নিস্তব্ধ। আমরা যেন কাঠের পুতুল।
চোখ মুদে রইল ইন্দ্রনাথ। সেকেন্ড কয়েক নীরবতার পর চোখ মুদেই বললে–চুইংগামের মোড়ক। নির্মাতা, ব্যাঙ্গালোরের একটি কোম্পানি। চুইংগাম খাওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু কী আশ্চর্য! মোড়কটা রয়েছে পকেটে! এরকম কখনও হয়? চোখ খুলল ইন্দ্রনাথচুইংগাম খেয়ে মোড়ক পকেটে রাখা হল কেন?
জবাব নেই।
ইন্দ্রনাথ বললে–এবার তিন নম্বর বস্তু। টিশু পেপারের হিজিবিজি ধাঁধা। সবচেয়ে জটিল হেঁয়ালি।
সাইফার আর কোড-এর মধ্যে তফাত আছে। দুটোই সাংকেতিক পন্থায় লেখা গুপ্তলিপি। কিন্তু সাইফার পদ্ধতিতে লেখা গুপ্ত-দলিল রহস্য নির্ভর করে একটি চাবির ওপর। সব-খোল চাবি বলা যায় তাকে। সেইটি জানলেই পুরো হেঁয়ালির সমাধান করা সম্ভব।
কিন্তু কোড তা নয়। অনেকগুলো প্রতীকচিহ্ন দিয়ে কোড লিখতে হয়। তাই কোড পদ্ধতিতে লেখা গুপ্ত-দলিল পড়তে হলে হাতের কাছে কোড বুক থাকা দরকার। বুঝলে?
না, গালে হাত দিয়ে বলল তীক্ষ্ণ নয়না গৃহিণী।
প্রাঞ্জল করছি। বর্ণমালার প্রত্যেকটা হরফের একটা চিহ্ন থাকে। যেমন, কয়ের বদলে জাহাজ, খয়ের বদলে পাহাড়, গয়ের বদলে চাঁদ। ক খ গ লিখতে হলে জাহাজ পাহাড় চাঁদ আঁকতে হবে। ক্লিয়ার?
হ্যাঁ।
ললিতমোহনের ঘরে কোডবুক পেয়েছিলাম কি?
না।
তাহলে সে সাইফার পদ্ধতি ব্যবহার করেছে। মূল সূত্র একটাই। চিন্তার ক্ষেত্র ছোট করে এনে যেই ভাবনা শুরু করেছি, অমনি একটা বাজে কথা বলে ঘোট পাকিয়ে দিল প্রেম।