বললাম তো, ফের দাঁত খিঁচোলেন ডাক্তার। ভেগাস নার্ভ উত্তেজিত হলে কার্ডিয়াক ইনহিবিশন হয়। জলে ডুবে মৃত্যু হলেও এরকম ঘটতে পারে।
কীরকম ভাবে?
ল্যারিংক্স অর্থাৎ স্বরযন্ত্রে ধাঁ করে খানিকটা জল ঢুকে গেলে ভেগাস নার্ভ খেপে ওঠে– ফলে ফুস করে থেমে যায় হার্ট। ভেগাস নার্ভকে হার্টের ব্রেক বলতে পারেন। ব্রেকের ওপর থেকে পা তুলে নিন অর্থাৎ ভেগাস নার্ভকে কেটে দিন–হার্ট ধড়ফড় করতে করতে এলিয়ে থেমে যাবে। আবার ঠিক উলটোটা ঘটবে ব্রেক টিপে ধরলে, ভীষণ ক্ষেপে উঠে ভেগাস নার্ভ হার্টকে ঘ্যাঁচ করে থামিয়ে দেবে। মিনিট কয়েকের মধ্যেই মৃত্যু ঘটবে। নারায়ণের ক্ষেত্রে মামুলি জলে ডোবা মৃত্যুর সচরাচর লক্ষণ দেখা যায়নি।
যথা–
মুখ বা নাকে ফেনা ছিল না। শিরাগুলোও দড়ির মতো হয়নি। দম বন্ধ হয়ে মারা গেলে রক্তের মধ্যে অক্সিজেন কমে যায়, কার্বন ডাই-অক্সাইড বেড়ে ওঠে। রক্তক্ষরণ হয়। কিন্তু নারায়ণের চামড়া ছিল ফ্যাকাসে।
এত গেল না-পাওয়ার ফর্দ। কাজের পয়েন্ট কিছু পেয়েছেন কি?
গুড পয়েন্ট। এতক্ষণ বললাম নেগেটিভ পর্যবেক্ষণ। এবার বলছি পজিটিভ পর্যবেক্ষণ। আমি দেখলাম, সে ঘুমের ওষুধ খেয়েছিল কিনা, অথবা কোনও চোট পেয়েছিল কিনা।
কোনওটাই পেলেন না?
কনুই আর গোড়ালিতে সামান্য ঘষটানির দাগ ছিল। সুইমিং পুলের তলাটা খুব এবড়ো খেবড়ো। চৌবাচ্চার পাড়ও খুব মসৃণ নয়। সুতরাং ওরকম ঘষটানি অস্বাভাবিক নয়। আর একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, নারায়ণের মুখের ভাব। যেন, অপ্রস্তুত ছিল, ভীষণ চমকে উঠেছিল। মুখ নীচের দিকে করে জলে ঝাঁপ দিলে এরকম হয়। জলের ওপর সপাং করে মুখটা আছড়ে পড়লে চমকে ওঠা স্বাভাবিক।
পেছন থেকে হঠাৎ কেউ ঠেলে ফেলে দিতেও তো পারে?
বললাম না, মারপিটের চিহ্ন পাইনি।
মারপিট করার দরকার কী? কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকলে পেছন থেকে জোর ধাক্কা মারলেই তো হল।
তা হতে পারে। কিন্তু ওইভাবে কেউ খুন করে কি?
হয়ত ঠাট্টাচ্ছলে ঠেলে দিয়েছিল।
কে ঠাট্টা করবে? গভীর রাত। বাড়িসুদ্ধ লোক ঘুমে অচেতন। ফটকে তালা। আস্তাবল, গ্যারেজ, চাকরদের কোয়ার্টারে খিল তোলা।
হা-র-র-উ-ম! গলা খাঁকারি দিল প্রেম–লাথি মেরে ফেলে দেয়নি তো?
ক্লিষ্ট হাসি হাসল ইন্দ্রনাথ, একটা লোক কিন্তু এখনও নিপাত্তা।
কে?
নিশাচর চোর।
চোরের সঙ্গে ধস্তাধস্তি দৌড়োদৌড়ি করলে কিন্তু নারায়ণের রক্তে অ্যাড্রেনালিন বেড়ে যেত। হৃদযন্ত্র চঞ্চল হত। ভেগাস নার্ভ সুবিধে করে উঠতে পারত না।
মাথা নাড়তে নাড়তে ইন্দ্রনাথ বললে–উলটোটাও তো ঘটতে পারে। ধরুন, গভীর রাতে বাড়ি ঢুকেছে চোর। এমন সময়ে দেখল নারায়ণ সিনয় সুইমিং পুলের পাড়ে দাঁড়িয়ে। পালাতেও পারছে না–কেননা পালানোর পথের দিকেই ফিরে দাঁড়িয়ে আছে সিনয়। তাই চুপিচুপি পেছনে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে ওকে জলে ফেলে দিয়েই ভো দৌড় দিয়েছে বাইরে। পুরো দৃশ্যটাই হয়ত দেখে ফেলেছিল ললিতমোহন বাইরে থেকে।
মাই গুড ডিটেকটিভ, মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন ডাক্তার–এ দৃশ্য দেখবার পর ললিতমোহন কি বাহবার লোভে তক্ষুনি পুলিশকে খবর দিত না?
হার মানল ইন্দ্রনাথ।
.
কাপের ওপর, ধোঁয়ার সুতোর পানে তাকিয়ে আত্মগতভাবে বলল ইন্দ্রনাথ-চারটে বস্তু আমরা চার জায়গায় পেয়েছিলাম। কিন্তু একবারও চারটে জিনিসকে পাশাপাশি রেখে একসঙ্গে চিন্তা করিনি। করলাম কাল রাতে। সমাধান পেলাম।
ডাগর চোখে অসীম কৌতূহল নিয়ে কেবল চেয়ে রইল কবিতা কথা বলল না।
ইন্দ্রনাথ তখন সিরিয়াস। ঈষৎ কুঞ্চিত চোখে একাগ্র তীক্ষ্ণতা। কণ্ঠে মাদলের দ্রিমি-দ্রিমি ধ্বনি।
এক নম্বর বস্তু–একটা সিগারেটের দগ্ধাবশেষ।
দুনম্বর বস্তু–চুইংগামের মোড়ক।
তিন নম্বর বস্তু হিজিবিজি লেখা টিশু বা ট্রেসিং পেপার।
চার নম্বর বস্তু–লোহার কোট ম্যাগাজিন।
পোড়া সিগারেট পড়ে ছিল ললিতমোহনের মৃতদেহের কিছু দূরে, কিন্তু বনলক্ষ্মী-ঋতেশের প্রেমশয্যা থেকে অনেক দূরে।
চুইংগামের মোড়ক ছিল ললিতমোহনের পকেটে।
ট্রেসিং পেপার ছিল শ্যামলেন্দুর জিম্মায় কফির বাকসে।
লোহার কোট ম্যাগাজিন ছিল ললিতমোহনের ঘরে।
পাশাপাশি চারটে জিনিস টেবিলে রেখে দেখলাম, শুধু সিগারেটটি ছাড়া সবগুলি বস্তুই ললিতমোহনের। সিগারেটটাই বা তার হবে না কেন?
ললিতমোহন হিরের টুকরো ছেলে। ধূমপান করে না। ঋতেশ করে। কিন্তু বনলক্ষ্মীকে ও যেখানে সাময়িক গৃহলক্ষ্মী বানিয়েছিল–
ভদ্রভাষায় বলো, ঘাড় কাত করে গালে হাত দিয়ে শুনতে শুনতেই মন্তব্য করল কবিতা।
সেখান থেকে পোড়া সিগারেট অতদূর যেতে পারে না। আরও একটা কারণে পোড়া। সিগারেটটা ঋতেশের নয়–তাতে অরেঞ্জ লিপস্টিকের ছাপ থাকলেও।
সে-কারণটা হল ফরেনসিক রিপোর্ট। পোড়া সিগারেটটা নাকি যথেষ্ট নাড়াচাড়া করা হয়েছে। সিগারেটের কাগজ দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। তাছাড়া, তামাকটা সদ্য পোড়া নয়– অনেকদিনের পোড়া।
অতএব ঋতেশ বাদ গেল।
সিগারেটটা তা হলে কার? হত্যাকারীর? যে ব্যক্তি এত আটঘাট বেঁধে হত্যা করে, সে এরকম অসতর্ক হবে, ভাবতেই পারি না। সূত্রটা অত্যন্ত মূল্যবান। কেননা, অকুস্থলে সিগারেট ফেলে যাবার মতো নির্বোধ নয় হত্যাকারী।
তবে কি পোড়া সিগারেট ললিতমোহনের পকেটেই ছিল?