শঙ্কিত, তটস্থ, হতচকিত রাখালরাজের সঙ্গে সৌজন্যসূচক বাক্য বিনিময় না করেই পেছন ফিরল ইন্দ্রনাথ।
গাড়িতে উঠেই বললে–প্রেম, মৃগ, ললিতমোহন মার্ডারের খবরটা আজকের কাগজে বেরোয়নি। কিন্তু কালকের কাগজে বেরোচ্ছেই। তাই তো?
নিশ্চয়। রিপোর্টাররা জ্বালিয়ে মারছে সারাদিন আমাকে আর ডাক্তারকে।
রাইট। কাল ভোর হওয়ার আগেই আরও খানিকটা তদন্ত যদি এগিয়ে রাখি, তোর আপত্তি হবে?
আপত্তি?
তবে চল আগে থানায়। নারায়ণ সিনয়ের জলে ডুবে মৃত্যুর পুলিশ রিপোর্ট দেখব।
তার কী দরকার? ডক্টর ডিকসিটের কাছেই চল না কেন? উনিই তো পোস্টমর্টেম করেছিলেন। কিন্তু তোর উদ্দেশ্য বুঝছি না। নারায়ণ-তদন্তে কোনও ফাঁক নেই। কেসটা এই শৰ্মাই হ্যান্ডল করেছিল। সেটা অ্যাকসিডেন্ট, আর ললিতমোহনেরটা মার্ডার।
জানি। উত্তেজনায় আঙুল মটকাতে মটকাতে বলল ইন্দ্রনাথ। খটকা লাগছে শুধু একটা জায়গায়।
কোন জায়গায়?
নারায়ণ সিনয় জলে ডুবে মারা গেছে ২৭ ডিসেম্বর। সেইদিন খুব অস্থির, অন্যমনস্কভাবে বাড়ি ফিরেছিল ললিতমোহন। রাত জেগে খুব সম্ভব ধাঁধা রচনা করেছিল এবং পরের দিন সকালে খবরের কাগজ থেকে খবরটা কেটে রেখেছিল। কেন?
.
রাত তখন নটা। ব্যাঙ্গালোরের পরিচ্ছন্ন পথঘাটে যানবাহনের সংখ্যা কমে এসেছে। স্টিয়ারিং ধরে নারায়ণ-তদন্তের প্রাঞ্জল বর্ণনা করল প্রেমাংশু।
কর্নেল হেব্বালের বাড়ির সামনে বাগান, পেছনে বাগান। ডাইনে গ্যারেজ, আস্তাবল, চাকরদের আউটহাউস। বাঁয়ে শেডের নীচে সুইমিং পুল। মানুষ-সমান উঁচু পুরু কাঁটাঝোঁপ দিয়ে আগাগোড়া ঘেরা।
নারায়ণ সাঁতার জানত না। তবুও জামাকাপড় পাড়ে খুলে রেখে নেমেছিল জলে। আর উঠতে পারেনি।
মোজাইক পাড়ে অ্যাশট্রেতে সিগারেটের ছাই পড়ে ছিল–সিগারেট ছিল না। সম্ভবত পাড়ে বসে ধূমপান করছিল নারায়ণ। হয়ত পা পিছলে পড়ে যায় আচমকা। অথবা, নিজে থেকেই সাঁতার শিখতে গিয়েছিল। তখন রাত গভীর।
প্রেমাংশু গিয়ে দেখেছিল, সবুজ রং করা সাঁতার কুণ্ডের তলদেশে চিৎপাত হয়ে শুয়ে নারায়ণের উলঙ্গ দেহ। হিপির মতো লম্বা চুল পাতাল নাগের মতো সহস্র ফণা বিস্তার করে রয়েছে ফর্সা মুখের ওপর। বছর তিরিশ বয়স। সুঠাম দেহ।
শুধু শুনেই গেল ইন্দ্রনাথ। প্রশ্ন করল না।
ঘাড় কাত করে অনিমেষ নয়নে কী যেন ভাবতে লাগল আপন মনে।
.
ডিকসিট ডাক্তারের অফিস কক্ষটি প্রাণীতত্ত্ববিদের সংগ্রহশালা বললেও চলে। চেয়ারের পেছনে কাচের শোকেসে ঝুলন্ত নরকঙ্কাল। পাশেই আর একটি শোকেস। তাতে রক্ষিত দুটি বানরের কঙ্কাল। বইয়ের আলমারি, যন্ত্রপাতির আধার, মাইক্রোকোপ, বেলজার।
প্রেম বলল–আমরা এসেছি।
তা তো দেখতেই পাচ্ছি, চেয়ার দেখিয়ে বললেন ডাক্তার–কিন্তু কেন?
নারায়ণ সিনয়ের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট শুনতে।
নারায়ণ সিনয়! ঈষৎ ঝুঁকে অসমান দাঁতের সারি বার করে যেন খিঁচিয়ে উঠলেন ডাক্তার তার সঙ্গে এই মার্ডারের কী সম্পর্ক?
ঝটিতি বচনজাল বিস্তার করল ইন্দ্রনাথ। সংক্ষেপে ব্যক্ত করল আপন সন্দেহ।
ডাক্তার উত্তর্ণ হয়ে শুনলেন। প্রথমে বাম কান পেতে। তারপর ডান কান ফিরিয়ে। শুনতে-শুনতে বাড়তে লাগল ছটফটানি। আর্মচেয়ারের হাতলে চঞ্চল হল দু-হাত। লাল হয়ে গেল কান। শেষকালে ফেটে পড়লেন বোমার মতো–ড্যাম ইট, ম্যান। কী বলতে চান? ভুল করেছি?
ভুলটা খুবই ছোট্ট, ডক্টর। কিন্তু আগে শেষ করতে দিন। ধরুন, ললিতমোহন চোর ধরার ফিকিরে একাই ঘুর ঘুর করত কেম্পেগৌড়া টাউনের রাস্তাঘাটে..হঠাৎ একদিন একটা শব্দ শুনল কর্নেল হেব্বালের বাড়ি থেকে। সন্দেহজনক শব্দ। গেল তদন্ত করতে। গিয়ে এমন কিছু দেখতে পেল, যে প্রসঙ্গে শ্যামলেন্দুকে পরে বলেছিল–পুলিশ শুনলে লাফিয়ে উঠবে। ও কি নারায়ণ সিনয়কে ডুবতে দেখেছিল?
স্বচক্ষে সে-দৃশ্য দেখবার পর কেউ মুখ বুজে থাকে?
তা ঠিক। মারপিট?
মারপিট! নারায়ণের সঙ্গে ধস্তাধস্তি?
ওইরকম কিছু।
অসম্ভব!
কেন?
নারায়ণ ছোকরা মারা গেছে হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে– কার্ডিয়াক ইনহিবিশন।
কিন্তু রিপোর্টারদের কাছে তা তো বলেননি?
কী বলেছিলাম?
পেপারকাটিংটা বার করে দিল ইন্দ্রনাথ–বলেছেন মামুলি জলেডোবা মৃত্যু।
ককখনো বলিনি।
এটা কী লিখেছে?
চোখ বুলিয়েই দমাস করে ইয়া মোটা বইটার ওপর মুষ্ট্যাঘাত করলেন ডাক্তার–ব্লাড়ি ফুল! ডাক্তারি কথা বলতে গেলে ইংরেজিতে ছাড়া কি বলা যায়? রিপোর্টার যদি শুনতে ভুল করে তো আমি কী করব।
আপনি কি বলেছিলেন?
আমি বলেছিলাম–Atypical drowning, ওরা লিখেছে–A typical drowning যার মানে একেবারেই উলটো।
চেয়ে রইল ইন্দ্রনাথ।
ডাক্তার দাঁত খিঁচিয়ে বললেন–অ্যাটিপিক্যাল–একটা শব্দ। মানে অস্বাভাবিক। ওরা সেটা এ টিপিক্যাল লিখে মানে করল, মামুলি! দুর! দুর!
ভুলটা কারও চোখে পড়ল না?
কী করে পড়বে? সবাই চাইছে ঝটক্সট ফাইল ক্লোজ করতে।
তা ঠিক। কাষ্ঠহেসে সায় দিল প্রেম।
ডাক্তার বললেন–নারায়ণ সিনয়ের মৃতদেহ প্লেনে করে কানাডায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মনে আছে? সেখানকার প্যাথলজিস্ট খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে যা বলেছিলেন, আমিও পুলিশ রিপোর্টে তাই লিখেছি–ভেগাস নার্ভ উত্তেজিত হওয়ায় হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে গেছে।
তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দিয়ে রগ টিপে ধরে কিছুক্ষণ গুম হয়ে রইল ইন্দ্রনাথ। তারপর –নারায়ণ সিনয়ের মৃত্যুর কারণটা তাহলে কী?