অতিথিটির নাম নারায়ণ সিনয়।
পলকহীন চোখে খবরটার পানে চেয়ে রইল ইন্দ্রনাথ।
স্বর ফুটল অনেকক্ষণ পরে। চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়ে বললে–কে এই কর্নেল হেব্বাল?
প্রেম বললে–মাইশোরের রাজা চামরাজাবাহাদুরের আত্মীয়। রাজরক্ত নিয়েই জন্ম। কিন্তু রাজত্বে অধিকার নেই। আত্মসম্মান প্রখর। প্রচণ্ড অহংকারী। মিলিটারিতে থেকেই বোধ হয় মেজাজটাও মিলিটারি। তবে ভালো স্পোর্টসম্যান। ব্যাঙ্গালোর পোলো ক্লাব ওঁর উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত। টেনিস, সাঁতার, ভলিবলেও সমান দক্ষতা। কলকাতার পোলো মরশুমে খেলতে যান ফি-বছর। হেব্বালের রাইফেল-রেঞ্জে যাতায়াত আছে!
একটু থেমে নিমীলিতনয়ন ইন্দ্রনাথের পানে বিরাগপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ফের হেব্বাল চরিত আরম্ভ করল প্রেমাংশু।
.
কর্নেল হেব্বাল শুধু উত্তম ক্রীড়াবিদ নন। বিপুল বিত্তের অধিকারীও বটে। পৈতৃক সম্পত্তির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্ত্রীর সম্পত্তি। কলকাতার রেসকোর্সের তত্ত্বাবধানের ভার নিয়েছিলেন। অবসর নেওয়ার পর। সেই সময়ে রেসের গ্রাউন্ডে আলাপ হয় ভদ্রমহিলার সঙ্গে। নাম তার মধুমাধবী। বঙ্গললনা।
মধুমাধবী নাম শুনলেই অবশ্য নীল-পদ্মের পাঁপড়ির কথা মনে পড়ে। যেন তার নীল নিচোল ঘিরে মুক্তাবলী, তমাল বেদিকায় এলিয়ে দিয়েছে তরুণ তনুশ্রী।
সেরকম কিছুই নয়। মধুমাধবী তিনি নামেই। সারা মুখে তার রক্তজবার অনুরাগ ছড়ানো। চোখে-মুখে অধরে চিবুকে রুদ্র ও ললিত লাস্যের নৃত্য।
মধুমাধবী একটি বিতর্কিত রূপ। অগ্নির মতো আকর্ষণীয়…স্নিগ্ধ নয়–উগ্র।
ঘোর কৃষ্ণবর্ণা, নাক মোটা, অধর পুরু, ভুরু ঘন। তা সত্ত্বেও অপূর্ব তাঁর দেহকান্তি, রক্তপদ্ম আঁখির তারায় অহর্নিশ চঞ্চলতা, পাতলা কোমর, গুরু নিতম্ব, পীবর বুকে উদ্দাম উচ্ছলতা।
মধুমাধবী! মধুমাধবী! মধুমাধবী! বছর কয়েক আগে এই মধুমাধবীকে নিয়ে চঞ্চল হয়েছিল স্বভাবশান্ত ব্যাঙ্গালোর নগরী। কর্নেল হেব্বাল আশ্চর্য সুপুরুষ। কর্নেল হেব্বাল রাজবংশীয়। সর্বোপরি, তিনি কর্ণাটক ক্ষত্রিয়। কিন্তু কী দেখে সহধর্মিণী রূপে নির্বাচন করলেন সুদূর বঙ্গ দেশের কৃষ্ণকায় রমণীকে? মধুমাধবী বয়েসেও অনেক ছোট। পিঙ্গল চোখে অনঙ্গ-দৃষ্টি। যেন রতি প্রতিমা।
বংশ মর্যাদায় আত্মসচেতন কর্নেল হেব্বাল যত্র-তত্র নিয়ে যেতেন না স্ত্রী-কে। বাজে লোকের সঙ্গ একদম পছন্দ করতেন না। কিন্তু উঁকিঝুঁকি মেরেও যেটুকু দেখা গিয়েছিল, তা যথেষ্ট।
প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী কর্নেল হেব্বাল যুবতী স্ত্রীকেও পর্দানশিন রাখার মন্ত্রগুপ্তি জানেন। কালক্রমে তার দুটি মেয়ে হয়েছে। কিন্তু মধুমাধবী আজও এক রহস্য।
এত কড়াকড়ির মধ্যেও কর্নেল হেব্বাল উদার ছিলেন। কেবল রামকৃষ্ণ আশ্রমের ক্ষেত্রে নাস্তিক। কিন্তু মেয়েদের নিয়ে মধুমাধবী প্রায়ই যান রামকৃষ্ণ আশ্রমে।
এহেন হেব্বাল পরিবারে আতিথ্য গ্রহণ করলেন নারায়ণ সিনয়। কানাডা প্রবাসী ম্যাঙ্গালোর তনয়। মাতৃভাষা, কঙ্কানীহঠাৎ শুনলে বাংলা ভাষা বলেই মনে হয়। কেন না, কঙ্কানীরা নিজেদের গৌরসারস্বত বলে। কারণ পূর্বপুরুষরা বাংলাদেশ থেকে এই অঞ্চলের ওপর দিয়ে বাণিজ্য করতে যেতেন গুজরাত অভিমুখে।
নারায়ণ সিনয় বাবা-মা-ভাই-বোনকে কানাডায় রেখে ব্যাঙ্গালোর এসেছিল বৈষয়িক কাজে। বাবার বন্ধু কর্নেল হেব্বালের আমন্ত্রণে উঠেছিল তার ভবনে। দিন পনেরো পরেই ঘটল এই দুর্ঘটনা।
.
নির্দয়ভাবে গালের একটি ব্রণকে নিষ্পেষন করতে করতে ইন্দ্রনাথ বললে–এত কথার মধ্যে একটা কথাই শুধু কাজের কথা।
কোনটা? ক্ষুব্ধ কণ্ঠ প্রেমাংশুর।
দুই মেয়েকে নিয়ে প্রায়ই রামকৃষ্ণ আশ্রমে যেতেন মধুমাধবী!
তাতে কী হল?
ললিতমোহনও রামকৃষ্ণ আশ্রমে যেতে ভালোবাসত। সেখানেই ওদের মধ্যে পরিচয় ঘটেনি তো?
.
জবাব শোনবার জন্যে ফের গেলাম বিন্দুমতীর কাছে। সঙ্গে প্রেমাংশু।
ললাট কুঁচকে উঠল বিন্দুমতীর। ভ্রূক্ষেপ না করে এবং বিন্দুমাত্র ভণিতা না করে ইন্দ্রনাথ শুধোলো–আপনি কি বলতে পারেন ললিতমোহনের সঙ্গে কর্নেল হেব্বালের মেয়েদের আলাপ হয়েছিল কিনা?
না।
রাখালরাজ সাহার গোপাল ভবন।
ভদ্রলোকের বিশাল গোঁফ ঝুলে পড়ল আমাদের ত্রিমূর্তি দেখে।
অকারণ হাসি হাসতেও বিস্মৃত হলেন।
বিনা গৌরন্দ্রিকায় শুষ্ককণ্ঠে শুধোলো ইন্দ্রনাথ–প্রবাসে বাঙালি মাত্রই সজ্জন, তাই তো?
আজ্ঞে?
শ্যামলেন্দু কোথায়?
আজ্ঞে..আজ্ঞে…
ডাকুন। এখুনি।
ত্বরিৎপদে অন্দরে অন্তর্হিত হলেন রাখালরাজ। হাত ধরে নিয়ে এলেন শ্যামলেন্দুকে। বেচারির শ্যামলিমা কালিমায় পরিণত হয়েছে একদিনের উদ্বেগ ভাবনায়।
শ্যামলেন্দু।
চশমার আড়ালে অশ্রুসাগরের আভাস পাওয়া গেল ওর ভীরু চোখে।
কেঁদো না। কোনও ভয় নেই। ললিত রামকৃষ্ণ আশ্রমে যেতে ভালোবাসত?
হ্যাঁ।
কর্নেল হেব্বালের স্ত্রী আর মেয়েরাও সেখানে যেতেন?
হ্যাঁ।
ললিতের সঙ্গে ওঁদের আলাপ ছিল কি?
আগে ছিল না, চশমা খুলে চোখ মুছতে মুছতে বলল শ্যামলেন্দু। আমার সঙ্গে কথা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আলাপ হয়েছিল।
তুমি কীভাবে জানলে?
স্কুলের বন্ধুদের কাছে। ললিতের সঙ্গে ছোট মেয়ের ভাব হয়ে গিয়েছিল। বাড়িতেও যেত।
কেম্পেগৌডার বাড়িতে?
হ্যাঁ।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইন্দ্রনাথ–যাও, আর প্রশ্ন নেই।