সতর্ক চোখে আমাদের নিরীক্ষণ করে বললেন স্বভাবকোমল কণ্ঠে–আসুন।
বারান্দার চেয়ারেই বসলাম আমরা। বিন্দুমতী বসলেন সামনে। আল্পনা আলোছায়ায় দেখলাম, তার চোখের পাতা ফুলো। অন্ধকারে অশ্রুপাত করছিলেন।
ইন্দ্রনাথ বললে–আমাকে ক্ষমা করবেন এই সময়ে বারবার বিরক্ত করার জন্যে।
অসংকোচে বলুন।
ললিতের একদিনের কাজের রুটিন কী ছিল বলবেন?
সকাল ছটায় ঘুম থেকে উঠত। বাথরুম। ব্যায়াম। সাতটায় আমরা সবাই মিলে কাগজ পড়তে-পড়তে জলখাবার খেতাম। নটা পর্যন্ত পড়াশুনা। তারপর স্কুল। বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে বেড়াতে যেত বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে। কোচিং ক্লাস সেরে বাড়ি ফিরত রাত নটায়। খাওয়া। ঘুম দশটার মধ্যে। যেন মুখস্থ বলে গেলেন বিন্দুমতী।
চমৎকার। এখন বলুন, মাসখানেকের মধ্যে এই রুটিনে কোনও হেরফের হয়নি?
না তো।
ললিতের সঙ্গে পরিবারের প্রত্যেকে মুখোমুখি বসতেন কখন কখন?
সকালে খবরের কাগজ পড়বার সময়ে আর রাত্রে খাবার সময়ে।
গত এক মাসের মধ্যে এই দুই সময়ে তার মধ্যে কোনও চাঞ্চল্য, অস্থিরতা, অন্যমনস্ক ভাব লক্ষ্য করেছিলেন?
বিন্দুমতী নিজেই অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। অনেকক্ষণ পরে মাথা নেড়ে বললেন–মনে। রাখতে হবে বলে তো কিছু দেখে রাখিনি। তবে
তবে কী? বলুন?
একটা সামান্য ব্যাপার। ধর্তব্যের মধ্যে নয়।
বলুন না।
এদেশের মানুষ চিনি ছাড়া দই খায়নুন মিশিয়ে। ললিতও সেই অভ্যেস করেছিল। সেইজন্যে ঘরে পাতা দই-তে চিনি থাকত না। আমরা চিনি মিশিয়ে নিতাম–ও মেশাত নুন। কোনওদিন ভুল হয়নি। একদিন হয়েছিল। নুনের বদলে চিনি মিশিয়ে ফেলেছিল। আমি ধরিয়ে দিতেই দই না খেয়েই উঠে গিয়েছিল ঘরে।
উজ্জ্বল হল ইন্দ্রনাথের চক্ষু।
শুধোলো ঈষৎ ঝুঁকে পড়ে–সেটা কবে বলতে পারেন?
সেদিন ছিল রোববার। মনে-মনে হিসেব করলেন বিন্দুমতী। দুটো রোববারের আগের রোববার। মানে, সাতাশে ডিসেম্বর।
মানে পয়লা তারিখের আগে। ফাইন! ফাইন! রিয়ালি ফাইন! অদম্য উত্তেজনায় আরও ঝুঁকে পড়ল ইন্দ্রনাথ–নুনের বদলে চিনি মিশোল ললিত, তারপর কী করল?
বিন্দুমতী বিস্মিত হলেন সুদর্শন গোয়েন্দার আকস্মিক উত্তেজনা দেখে।
বললেন–ঘুমিয়ে পড়ল।
আপনি দেখেছিলেন?
আমি? না। তবে রাত জেগেছিল বোধ হয়। কেন না, পরদিন ঘুম থেকে উঠল সাতটায়।
ফাইন! তারপর? আবার নুনের বদলে চিনি মেশায়নি?
এবার স্পষ্ট বিরক্তি দেখা গেল বিন্দুমতীর চোখে। বললেন–জলখাবারে দই খায় না কেউ।
তা ঠিক..তা ঠিক…কিন্তু জলখাবার খেতে গিয়ে অন্যমনস্ক হয়নি ললিত?
খেলো আর কোথায়? কাগজ পড়তে-পড়তে হঠাৎ উঠে গেল নিজের ঘরে।
কাগজ নিয়ে, না খাবার নিয়ে?
কাগজ নিয়ে। মেসোমশাই রাগারাগি করতে লাগলেন কাগজ না পাওয়ার জন্যে। সেই কাগজ পাওয়া গেল রাত্রে।
তার মানে? সেদিন তো সোমবার। কাগজ নিয়েই স্কুল গিয়েছিল নাকি?
মনে তো হয়।
অস্থির হয়ে আঙুল মটকাতে-মটকাতে ইন্দ্রনাথ বললে–আঠাশে ডিসেম্বরের কাগজ কি এখনও আছে?
আছে। আমরা তিন মাস অন্তর কাগজ বেচি।
দেখতে পারি?
কাগজটা? নিশ্চয়। বসুন, এনে দিচ্ছি, বিখ্যাত গোয়েন্দার মস্তিষ্কের সুস্থতা সম্বন্ধে সন্দিহান হয়েই যেন এস্তে উঠে গেলেন বিন্দুমতী।
অমনি ফিসফিস করে ইন্দ্রনাথ বললে–রাত জেগেছিল কেন বলো তো? নিশ্চয় লোহার কোটের সেই ধাঁধা রচনা করেছিল। পয়লা তারিখে ছেপে বের করতে হবে তো।
বিন্দুমতী ফিরে এলেন। হাতে পুরোনো ডেক্যান হেরাল্ডব্যাঙ্গালোরের ইংরেজি দৈনিক।
জ্বরগ্রস্ত ক্ষিপ্রতায় পাতা উলটে গেল ইন্দ্রনাথ।
বিজয়োল্লাসে চেয়ে রইল মাঝের পৃষ্ঠার পানে।
ষষ্ঠ কলমের বেশ খানিকটা অংশ কাঁচি দিয়ে কেটে নেওয়া হয়েছে।