সবাই তাই করে। কোবিনের জ্বালায় আমিও করি। বড় দুরন্ত ছেলে।
হা-র-র-উ-ম গলা খাঁকারি দিল প্রেমাংশু।
কী হল? চমকে উঠল ইন্দ্রনাথ।
কবজি ঘড়িতে তর্জনী ঠেকিয়ে বললে প্রেম–এক্ষুনি থানায় না গেলেই নয়।
সেকী কথা! যেন আকাশ থেকে পড়লেন প্রফেসর। শুঁয়োপোকার বাকি আধখানা না দেখেই যাবেন?
আপনি দেখুন।
চোয়াল সঞ্চালন করে শুষ্ক হেসে বললেন প্রফেসর–তাই কি হয়? আর একটা মিনিট থেকে যান। ইন্টারেস্টিং!
পিপীলিকা-বাহিনী যেদিকে চলেছে, সেইদিকেই অতি সন্তর্পণে পা টিপে টিপে এগিয়ে চললেন প্রফেসর এবং ধারাবিবরণী চলতে লাগল ভরাট গম্ভীরকণ্ঠে–পিঁপড়েরা মাথায় বোঝা নিয়ে সোজা লাইনে যায়–সেই হিসেবে আমি এখুনি বলে দেব শুঁয়োপোকা লুঠ করে গুদামে তুলতে ওদের কত সময় লেগেছে। এই দেখুন পিঁপড়ের বাসা। কী দেখছেন? মাটি যেন ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছে। কেমন? পা দেবেন না…পা দেবেন না…কামড়ে ঘা করে দেবে। দিন তো আমার ছোট্ট শাবলটা…হ্যাবারস্যাকে আছে…থ্যাঙ্কস্।
হাতখানেক লম্বা একটা শাবল নিয়ে মাটি খুঁড়তে শুরু করলেন প্রফেসর। পিঁপড়ের বাসা ঘিরে বৃত্তাকারে রেখায় কোপ মারতেই পিলপিল করে পিঁপড়ের দল বেরিয়ে এল পাতালরন্ধ্র থেকে। হাবভাব দেখেই বোঝা গেল, তারা বিলক্ষণ ক্রুদ্ধ। ভূগর্ভগৃহ আক্রান্ত হওয়ায় রেগে আগুন।
নিরাপদ ব্যবধানে সরে দাঁড়াল ইন্দ্র আর প্রেম। প্রফেসরের ভূক্ষেপ নেই। দুর্বোধ্য মারাঠি ভাষায় পিঁপড়েদের সম্বোধন করে ভাষণ দিয়ে চললেন বিরামবিহীনভাবে। ভদ্রলোক নিঃসন্দেহে ছিটগ্রস্ত।
পিঁপড়েরা পালিয়েছে। রুদ্রমূর্তি শাবলের ভয়ে, অথবা অনর্গল বচনের ভয়ে। একটা বড়সড় মাটির চাঙড় দু-হাতে তুলে উলটো করে বসালেন প্রফেসর।
মৌচাকের খুপরির মতো অসংখ্য গর্তের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বললেন বিজয়োল্লাসে– দেখেছেন?
প্রথমে কিছুই দেখা গেল না। তারপর ভুরু কুঁচকে ইন্দ্রনাথ বললে–একটা সাদা গুটি দেখতে পাচ্ছি বটে।
মাকড়সার জালের মতো সূক্ষ্ম তন্তু দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা শ্বেত গুটিকাটি সন্তর্পণে তুলে নিয়ে আবরণ খসিয়ে ফেললেন প্রফেসর।
টুপ করে হাতের তেলোয় গড়িয়ে পড়ল আধখানা শুঁয়োপোকা, সবুজ রোমশ দেহ।
ফের সঞ্চালিত হল চোয়াল। খিকখিক হেসে বললেন প্রফেসর–এবার সময়টা শুনুন। শুঁয়োপোকা জবাই হয়েছে গতকাল দুপুরের আগে সকাল নাগাদ।
স্থির চোখে চেয়ে রইল ইন্দ্রনাথ।
প্রেমাংশু যেন খাবি খেল অকারণেই–বলেন কী! কাস্তে নিয়ে হত্যাকারী এখানে এসেছিল খুনের অনেক আগেই?
হ্যাঁ, অনেক আগেই শুষ্ককণ্ঠ ইন্দ্রনাথের। এবার বুঝলে কেন বলছিলাম এটা কি নিছক যৌন হত্যা?
আমি…আমি।
খুনটা সুপরিকল্পিত।
প্রফেসর গোড়বোলেকে চন্দনবনে রেখেই ইন্দ্রনাথ আর প্রেমাংশু এল থানায়।
নটরাজ নামক অধস্তন অফিসারটি নীরস রিপোর্ট পেশ করে গেল সঙ্গে সঙ্গে। লোহার কোট ডিটেকটিভ ক্লাবের বাকি তিন সদস্যের বাড়ি তদন্ত করে এসেছে সে। সব জায়গাতেই একটি প্রশ্নই করা হয়েছে। গতকাল বিকেল পাঁচটা থেকে ছটার মধ্যে ললিতমোহন কার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল?
কেউ সদুত্তর দিতে পারেনি।
যত ধোঁয়া তো ওইখানেই, টেবিলের ওপর পা তুলে দিয়ে নাচাতে নাচাতে বলল প্রেমাংশু। পাঁচটা থেকে ছটার মধ্যে হত্যাকারী তাকে ভুলিয়ে নিয়ে গিয়েছিল চন্দনবনে। ওইখানেই ওকে খুন করার মহড়াও দেওয়া হয়েছিল সকালবেলা। কিন্তু লোকটা কে?
জবাব ধাঁধার মধ্যে, সিগারেটের ছাই ফেলতে-ফেলতে বলল ইন্দ্রনাথ।
সুতরাং ইন্দ্রনাথ একাই ফিরল গান্ধীনগরের ফ্ল্যাটে।
তখনও খাটের কোণে দেহটাকে অদ্ভুতভাবে বেঁকিয়ে বসে আছে ইন্দ্র। যেন একটা ময়াল সাপ। কুণ্ডলী পাকিয়ে উপবিষ্ট। জ্বলন্ত সিগারেটের অগ্রভাগ সাপের মণির মতোই বিকিরণ করছে রক্তকিরণ।
মৃগ।
হ্যাঁ, বল।
একটা প্রশ্ন। ললিতমোহন হিরের টুকরো ছেলে। কিন্তু হপ্তা তিন-চার একনাগাড়ে কোনও চাঞ্চল্যকর রহস্য নিয়ে যদি তার মগজ ব্যস্ত থাকে, তা হলে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটবেই দৈনন্দিন কার্যকলাপে। ঠিক কিনা?
বিলকুল।
আর একটা প্রশ্ন। শ্যামলেন্দুর সঙ্গে ললিতমোহনের আড়ি হয়ে গেল। কিন্তু জেদ চেপে গেল ললিতের। তার মানে কেম্পেগৌড়া টাউনে লুকিয়ে-চুরিয়ে টহল দেওয়া অব্যাহত রইল। ঠিক কিনা?
বিলকুল।
তবে চল।
কোথায়?
বিন্দুমতীর কাছে।
কফি খেয়ে যা।
কফি না আসা পর্যন্ত ময়াল সাপের মতোই কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে রইল বন্ধুবর। ধকধক করে কেবল জ্বলতে লাগল সৰ্পৰ্মণি।
কফি আর কাজু নিয়ে ঘরে ঢুকে আলেকজান্ডার ভড়কে গেল ইন্দ্রনাথের বসার ধরন দেখে। ট্রে-টা হাত থেকে টেনে নিয়ে ওকে বিদেয় করলাম ঘর থেকে।
বেদে চেনে সাপের হাঁচি। ইন্দ্রনাথ নিশ্চয় কোনও সূত্রের সন্ধান পেয়েছে।
.
অলংকার সিনেমার সামনে থেকে স্কুটার-রিকশা নিয়ে লালমহল পৌঁছোতে বিশ মিনিটও লাগল না।
প্রৌঢ় ভৃত্যটি আমাদের প্রতি চকিত চাহনি নিক্ষেপ করে ক্ষিপ্রপদে অন্তর্হিত হল অন্দরে। পরক্ষণেই বরান্দায় আবির্ভূত হল দীর্ঘকায়া বিন্দুমতী।
মোরাদাবাদী ল্যাম্পশেডের আল্পনা আলোছায়ার মধ্যে দিয়ে দেখলাম আজও তাঁর পরনে ছাপাশাড়ি। চওড়া চোয়াল যেন আরও রুক্ষ। শূকরের ল্যাজের মতো খর্বকায় বিনুনি এলিয়ে ঘাড়ের ওপর। বেশভূষায় সাজসজ্জায় কোনও ছিরিছাঁদ নেই।