শুনে, দৃষ্টি বিনিময় করল প্রেম আর ইন্দ্র। রক্তে ন্যাকড়া চুবিয়ে ছিটোতে গেলে জ্যাকেটের হাতায় সে রক্ত লাগবেই। তাই খাঁটি বাংলায় প্রেমকে বললে ইন্দ্র–জহুরি জহর চেনে, বেগুনওলা চেনে বেগুন।–খুব হয়েছে, চল এবার।
ভ্রূকুঞ্চিত করে শুধোলেন বৃদ্ধ গোড়বোলে–কী বললেন?
বললাম যে, এভাবে রক্ত ছিটোচ্ছেন কদ্দিন?
বললাম তো তিন বছর।
বলেন কী?
কোনও খবরই রাখেন না। ইংল্যান্ডের সায়ান্টিস্টরা সাতাশ বছর ধরে জঙ্গলে বসে আছে একটানা। আমাকেও আসতে হয় আটঘণ্টা অন্তর। মরা ছুঁচো ফেলে দিয়ে নতুন ছুঁচো রাখি ফঁদে।
আচ্ছা তাহলে উঠি। অনেক ধন্যবাদ।
দাঁড়ান। যাবার আগে বলে যান কেন এসেছিলেন, দুই চক্ষু সঙ্কুচিত হল প্রফেসর গোড়বোলের। মুহুর্মুহু নড়তে লাগল চওড়া চোয়াল। এত বোকা ভাববেন না আমাকে। আমি চন্দনবনে রাত বারোটায় গিয়েছিলাম কিনা, তুচ্ছ এই ব্যাপারটা জানবার জন্যে একজন পুলিশ অফিসার বাড়ি বয়ে এলেন কেন? কেন আমাকে ঘুম থেকে না তুলে আমার ছেলেকে প্রশ্ন করলেন রক্ত সম্পর্কে? দুই চক্ষু আরও সূচ্যগ্র হয়ে এল বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিকের। বলুন, কী চার্জ আমার বিরুদ্ধে।
জীবনে এরকম ফাঁপড়ে পড়েনি প্রেমাংশু। নরহত্যার সন্দেহে খরগোশ-হত্যাকারীর পেছনে ধাওয়া করার কাহিনি কি বলা যায়? তাই করুণ চোখে ইন্দ্রনাথের পানে তাকাল প্রেমাংশু।
ব্যক্তিত্বই পুরুষের বড় সহায়। সঙ্গিন পরিস্থিতিতেও তাই অটল থাকে ইন্দ্রনাথ রুদ্র।
জাঁদরেল প্রফেসর গোড়বোলের সূচীতীক্ষ চাহনির সামনেও অমায়িক হেসে এগিয়ে এল ইন্দ্রনাথ।
দু-হাত বাড়িয়ে প্রফেসরের দক্ষিণ হস্ত মুঠির মধ্যে নিয়ে বললে–আমরা এসেছিলাম আপনার সাহায্য ভিক্ষা করতে। আপনার ব্যস্ততা দেখে ফিরে যাচ্ছি।
কী সাহায্য?
বলছি। কোবিনকে খেলতে পাঠান। এর সামনে বলা যাবে না।
মেশিনগানের ঘোড়া টিপতে টিপতে ভোঁ দৌড় দিল কোবিন।
ইন্দ্রনাথ তখন সংক্ষেপে নিবেদন করল ললিতমোহনের নৃশংস নিধনকাহিনি। শুনতে শুনতে চক্ষু বিস্ফারিত হল গোড়বোলের, নাসিকারন্ধ্র স্ফীত হল, চঞ্চল হল চোয়াল।
সবশেষে বলল একটা কাঁচা মিথ্যে–আপনার সুনাম আগেই শুনেছি। আপনি অকুস্থলে গিয়েছিলেন শুনে ছুটে এসেছিলাম যদি কোনও সূত্র পাওয়া যায়, এই আশায়। প্রকৃতির নিকেতন। আপনার নখদর্পণে। এক নজরে আপনি যা দেখবেন, আমাদের চোখে তা অদৃশ্য থেকে যাবে।
খোশামোদ শুনলে যমরাজও নাকি গলে যান। প্রফেসর তো মানুষ। একগাল হেসে আমন্ত্রণ জানিয়ে বসলেন তক্ষুনি।
এ আর বেশি কী কথা। আসুন আমার সঙ্গে।
.
বিকেল চারটে। চন্দনবনে সেই গাছ–যার দুটি শাখা গুলটিপের আকারে উঠে গেছে ঊর্ধ্বে।
অনতিদূরে ঝরাপাতা আর শুকনো ডালের তলা দিয়ে লাইন বেঁধে চলেছে পিঁপড়ের দল। একদৃষ্টে চেয়ে আছেন প্রফেসর। যেন নিমীলিতনয়ন বুদ্ধদেব। কাঁধে হ্যাভারস্যাক।
সিগারেটের প্যাকেট অর্ধেক করে এনেছে প্রেম আর ইন্দ্র। ধৈর্যচ্যুতি ঘটলেও প্রকাশ করছে না মুখে। বিরক্তির সঙ্গে যে কৌতূহলও মিশে রয়েছে।
কৌতূহল আধখানা শুঁয়োপোকা নিয়ে।
সবুজ রঙের শুঁয়োপোকা। সদ্য গুটি থেকে বেরিয়ে যারা বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধা নিয়ে কেবল পাতা চর্বণ করে চলে, সেই পোকা।
কিন্তু তার আধখানা লাশ পাওয়া গিয়েছে। পিঁপড়েরা ঘাড়ে বয়ে নিয়ে চলেছে লোমশ পশ্চাৎপ্রদেশটি।
গোড়বোলে স্বগতোক্তি করলেন–ইন্টারেস্টিং।
ইন্টারেস্টিং! প্রতিধ্বনি করল ইন্দ্রনাথ রুদ্র।
ঘাড় নাড়তে নাড়তে পিপীলিকা-বাহিনীর পানে তাকিয়েই বললেন প্রফেসর–এক মিনিটে কতটা পথ হাঁটছে, সে হিসেব বেরিয়ে গিয়েছে। এখন দেখছি শুঁয়োপোকাটাই বেশি ইন্টারেস্টিং।
কেন ইন্টারেস্টিং? ধ্যানস্থ গোড়বোলের কানের কাছে যেন মন্ত্রোচ্চারণ করল ইন্দ্রনাথ।
গোড়বোলের চোখ নেমে এল আধখানা শুঁয়োপোকার ছইঞ্চি ওপরে–ফাইন কাট। কুচ করে পরিষ্কারভাবে কাটা। পাখির চঞ্চুতে এত ধার থাকে না।
উদ্ভাসিত হল ইন্দ্রনাথের চক্ষু। আগ্রহের রোশনাই জ্বলে উঠল প্রেমাংশুর ব্যাজার মুখে।
জানেন তো শুঁয়োপোকারা গুটির খোলস থেকে বেরিয়ে ডালের ওপর দিয়ে গুটিগুটি যায় রেলগাড়ির মতো, ওপর দিকে তাকালেন প্রফেসর। ডালের ওপরে কে কাটল একে?
বলতে-বলতে উঠে দাঁড়ালেন ইকলজিস্ট এবং অস্ফুট চেঁচিয়ে উঠে দৌড়ে গেলেন। পিপীলিকা বাহিনীর লাইন বরাবর উলটোদিকে।
একটা চন্দনগাছের ডাল মাটি থেকে মাত্র এক হাত ঊর্ধ্বে সমান্তরালভাবে গিয়ে উঠে গেছে ওপরে। ডালটা এত নীচু যে দাঁড়িয়ে থেকে আঙুল দিয়ে স্পর্শ করা যায়।
ডালের ওপর একটা গভীর কাটার দাগ। অর্ধচন্দ্রাকারে ছালটা কেটে গেছে ডালের এপাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত।
চিন্তাকুল চোখে তাকিয়ে শুধোলেন প্রফেসর–ডালটা এভাবে কাটল কেন?
কাস্তের কোপ, বলল ইন্দ্রনাথ।
কাস্তে? ঠিক, ঠিক। কাস্তেই বটে। কেন?
খুন করার জন্যে। রক্ত আছে? চুল?
না। একটু সবুজ ছোপ আছে কাটার দুধারে। শুঁয়োপোকা হত্যার চাক্ষুস প্রমাণ। বংশষ্টির মতো দীর্ঘকায় বপু বেঁকিয়ে পলকহীন চোখে বললেন প্রফেসর।
সত্যিই তাই। ডালের পাশে আরও কয়েকটি সদ্যোজাত শুঁয়োপোকার নড়াচড়াই তার প্রমাণ।
ইন্দ্রনাথও চেয়েছিল নির্নিমেষে, বলল মৃদুকণ্ঠে–হত্যাকারী অন্য কাজে হাত লাগিয়েছিল। তাই কাস্তেটাকে কোপ মেরে আটকে রেখেছিল গাছের ডালে।