শুঁয়োপোকার দ্বিখণ্ডিত লাশ আবিষ্কারের পর প্রমাণ পাওয়া গেল ইন্দ্রনাথের যুক্তিসিদ্ধ অনুমিতির।
.
প্রফেসর আই এস গোড়বোলের আবাসে হাজির হল ইন্দ্রনাথ, সঙ্গে প্রেমাংশু। সিঁড়ি বেয়ে উঠেই চওড়া বারান্দা। কাঠের রেলিং দিয়ে ঘেরা। বারান্দার ওপরেই কাচের দরজা। ওপাশে বসবার ঘর, সোফা সেট, টেবিল, কাবোর্ড টিপয়, বইয়ের আলমারি।
দরজার দিকেই কাবোর্ডের কাচের পাল্লার মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে হ্যাঁঙ্গারে ঝোলানো সারি সারি জ্যাকেট। চামড়ার, ফোম রাবারের এবং উলের। নীচের র্যাকে ছড়ি, কিটব্যাগ, ক্যানভাস থলি।
ইন্দ্রনাথের ঈগল-চাহনি কাচের দরজা খুঁড়ে কাবোর্ডের পাল্লা ভেদ করে নিবদ্ধ হল কিনারার জ্যাকেটের হাতায়। ধূসর রঙের চামড়ার জ্যাকেট। বাইরে বেরোনোর পোশাক। হাতায় এক ধ্যাবড়া বাদামি ছাপ।
এদিক-ওদিক দেখে নিল ইন্দ্রনাথ। বারান্দায় বা বাগানে কেউ নেই। আলবার্ট ভিক্টর রোড বেলা তিনটার সময়ে যানবাহন-শূন্য।
কাচের দরজা ঠেলতেই খুলে গেল। সটান কাবোর্ডের সামনে গিয়ে দাঁড়াল দুই বন্ধু।
আঙুলের ডগায় খানিকটা বাদামি পদার্থ তুলে নিল ইন্দ্রনাথ। থুথু দিয়ে ভিজোতেই গোলাপি হয়ে গেল থুথুর রং।
আঘ্রাণ নিল নাকের কাছে তুলে। নাঃ, আর সন্দেহ নেই। রক্তই বটে!
দৃষ্টি বিনিময় করল দুই বন্ধু। কিন্তু উল্লাস উবে গেল আচম্বিতে পেছন থেকে বজ্রকণ্ঠে হুংকার শুনে,
হ্যান্ডস আপ।
রিভলভার বের করারও সময় পাওয়া গেল না।
ঊর্ধ্ববাহু হয়ে গৌর-নিতাই বনে গেল দুই গোয়েন্দা।
অ্যাবাউট টার্ন, কচিকণ্ঠে নিনাদ শোনা গেল আবার।
যন্ত্রচালিতের মতো পেছন ফিরল মানিকজোড়। দেখল মেশিনগানধারী আততায়ীকে। বয়স তার বড়জোর পাঁচ। প্রায়-নীল সুন্দর চোখ, আপেল রাঙা টুকটুকে গাল, লাল বুট, কালো নাইলন টাউজার্স এবং ফোম রাবারের জংলি প্যাটার্ন জ্যাকেট। দু-হাতে রংবেরঙের প্লাস্টিকের তৈরি মেশিনগান।
ফিক করে গালে টোল ফেলে হেসে ফেলল শিশু-দস্যু।
বলল–হু ইউ?
ফ্রেন্ড, হাত নামাল ইন্দ্র।
ফায়ার! কচিকণ্ঠে ফের ধ্বনিত হল বজ্রনিনাদ। সঙ্গে-সঙ্গে আঙুল ওঠানামা করতে লাগল মেশিনগানের ট্রিগারে।
অঁ-অঁ-আঁ-আঁ আওয়াজের সঙ্গে নলচের মুখ দিয়ে বিচ্ছুরিত হল আগুনের ঝিলিক চকমকির ফুলকি।
কপট আতঙ্কে শিউরে উঠেই বুক খামচে ধরে ধপ করে হাঁটুর ওপর বসে পড়ল ইন্দ্রনাথ। জিভ বের করে থুতনি নামিয়ে আনল বুকের ওপর।
ডেড। হৃষ্টচিত্তে বলল শিশু দস্যু।
বিস্ফারিত চোখে এতক্ষণ তাকিয়েছিল প্রেম।
এবার বললে–কেয়া নাম হ্যায় তুমহারা?
কোবিন।
প্রফেসর গোড়বোলে কৌন হ্যায়?
পিতাজী।
চোখ খুলে বললে ইন্দ্রনাথ–দেখো কিতনি ব্লাড নিকলায়া।
ভয় কী? হিন্দিতেই বললে কোবিন, বাবার হাতে রোজ রক্ত লেগে থাকে।
তাই নাকি? কীসের রক্ত?
খরগোশের। রোজ খরগোশ মেরে রক্ত নিয়ে যায় বাবা।
আস্তে আস্তে চোয়াল ঝুলে পড়ল প্রেমাংশুর। সকৌতুকে বন্ধুবরের মুখাবয়ব নিরীক্ষণ করে নিয়ে ফের শুধোলো ইন্দ্রনাথ–কী করেন বাবা?
রিসার্চ। মাঠেঘাটে ফাঁদ পেতে রাখে। আমি বাঘের কুকুর খাওয়া দেখেছি। সাপের ইঁদুর খাওয়া দেখেছি খাঁচার মধ্যে। বাবা দেখিয়েছে। আমার মা নেই কিনা, তাই।
আচমকা ভেতর থেকে ভরাট গম্ভীর গলায় হাঁক শোনা গেল—
কোবিন।
ছুটে ভেতরে ঢুকে গেল কোবিন। তড়বড় করে কী যেন বলল প্রশ্নকর্তাকে। পরমুহূর্তে হাত ধরে যাকে টেনে নিয়ে এল, তিনিই নিঃসন্দেহে প্রফেসর গোড়বোলে।
ভদ্রলোক অতিশয় দীর্ঘকায়। ছফুট হওয়াও বিচিত্র নয়। রোদেপোড়া তামাটে মুখ। বয়স কম করেও ষাট। মুখে এবং দেহে অনাবশ্যক মাংস বা মেদ নেই। হাড়ের ওপর শুধু চামড়া। অন্তর্ভেদী চক্ষু। সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য চোয়ালে। মুখের অনুপাতে বেশ বড়। ঠেলে বার করা। অসম্ভব আত্মপ্রত্যয়ের লক্ষণ।
প্রফেসর বোধহয় দিবানিদ্রায় মগ্ন ছিলেন। চোখে ঘুমের আভাস। পরনে স্লিপিং স্যুট।
ইন্দ্রনাথকে অঙ্গুলি সংকেতে দেখিয়ে লাফাতে-লাফাতে বললে কোবিন–একে মেরে ফেলেছি।
তীক্ষ্ণ চোখে দুই বন্ধুর আপাদমস্তক দেখে নিলেন প্রফেসর গোড়বোলে।
পুলিশ দেখছি। আমার কাছে কেন?
আমতা-আমতা করতে লাগল বেচারি প্রেমাংশু। আড়চোখে তাকাল ইন্দ্রনাথের পানে। কিন্তু দুই চোখে তার নীরব কৌতুক। ঠোঁট দৃঢ়সংবদ্ধ।
অগত্যা প্রেমকেই বলতে হল কাষ্ঠ-হেসে–গতকাল রাত বারোটায় আপনি চন্দনবনে গিয়েছিলেন?
তা তো যাবই। আজকেও গেছিলাম সকাল আটটায়। আবার যাব এখুনি–চারটে বাজলেই। আমার কাজই যে তাই।
কাজটা কী, তা প্রকাশ পেল অচিরেই। প্রফেসর গোড়বোলে মহারাষ্ট্রীয় ক্ষত্রিয়। পূর্বপুরুষ শিবাজীর পক্ষে অস্ত্র ধারণ করেছিলেন। উনি কিন্তু জীবজগৎ নিয়ে সমাহিত। ইকলজি ওঁর গবেষণার বস্তু। প্রাণীকুলের সাথে পরিবেশের সম্পর্ক–এই নিয়েই বছরের পর বছর তিনি বিস্তর তত্ত্ব আবিষ্কার করে চলেছেন।
ব্যাঙ্গালোর থেকে আড়াইশ মাইল দূরে ম্যাঙ্গালোর। ম্যাঙ্গালোর থেকে মাইল কয়েক উত্তরমুখো গেলেই আরব সাগরের তীরে মণিপাল। সেখানকার মেডিক্যাল কলেজে তিনি বহু জন্তু-জানোয়ার নিয়ে সাধনা করে চলেছেন বছর দশেক। ব্যাঙ্গালোরে এসেছেন বছর তিনেক।
রক্ত দরকার হয় ওই কারণেই। ইন্দ্রনাথের প্রশ্নের উত্তরে সুবিশাল চোয়াল নেড়ে শুষ্ক হেসে নিবেদন করছেন প্রফেসর। খরগোশ বা ওই জাতীয় নিরীহ প্রাণী হত্যা করে প্লাস্টিক থলি বোঝাই রক্ত নিয়ে যান বনে-বাদাড়ে। ফঁদের আশেপাশে ন্যাকড়ায় ভিজিয়ে ছিটিয়ে দেন রক্ত। নইলে বেঁজি ধরা পড়বে কী করে। ছুঁচো কী খায় এবং ছুঁচোকে কে খায়, জানবেন কী করে?