প্যাটার্ন!
উদ্দেশ্য তো শরীরটাকে ক্ষত-বিক্ষত করা। বেশি আক্রোশ ঊরুসন্ধিতে। ডাইনে বাঁয়ে তলপেটে এলোপাতাড়ি কোপ। ধরতে পারছেন না?
হাত ফসকেছিল তো? রাইট। কিন্তু হাত ফসকালো কেন? এই নিন আমার বলপয়েন্ট পেন। স্ট্যাব করুন! কুইক! ফসকালো না, দেখলেন?
হত্যাকারী হয়ত উত্তেজিত হয়েছিল।
উত্তেজিত হলে এমন সমানভাবে হাতে পায়ে কোপ মারে? এই নিন আমার ফুটরুল। আগাটা ধরুন। নিন, ডগা দিয়ে আমার আঙুলের ডগায় মারুন। কুইক! পারলেন না!
সত্যিই, এক ইঞ্চি দূর দিয়ে ফসকে গেল প্রেমাংশুর হাতের ফুটরুল। দ্বিতীয়বারে অবশ্য লক্ষ্যে পৌঁছোল রুলের ডগা।
ডান পা থেকে বাঁ-পায়ের দেহভার ন্যাস্ত করে দাঁড়াল ইন্দ্রনাথ। ময়না তদন্ত আগ্রহের সঞ্চার করেছে তার মস্তিষ্কে।
ডাক্তার বললেন–তাহলেই দেখুন, অস্ত্র যত লম্বা হবে, আপনারও তত বেশি প্র্যাকটিস থাকা চাই। নইলে তত বেশি হাত ফসকাবে। কলমের পেছন ধরে কি লেখা যায়? নিবের কাছে ধরতে হয়। ঠিক কিনা?
বুঝলাম। ছুরিটা লম্বা।
খুবই লম্বা। শুধু লম্বা নয়, ফলাটা বাঁকানো। আধখানা চাঁদের মতো বললেও চলে। এরকম ছুরি কখনও দেখেছেন?
হত্যাকারী কি ল্যাটা? প্রেমাংশু পালটা প্রশ্ন করে বসল, ডাক্তারকে।
চোটগুলোর ধরন দেখে মনে হচ্ছে–ল্যাটা। বাঁ-হাতে অভ্যস্ত। দেখছেন না, ডানদিকে হেলে কোপ পড়েছে। অথচ গলায় তারের ফঁস দেখে মনে হচ্ছে ডান হাতটাই চলে ভালো।
দুজন হত্যাকারী ছিল কি?
দরকার ছিল কি?
কিন্তু বাঁ-হাতে ছুরি চালানো তো অসুবিধে।
তা হলে ছুরি নিয়েই আবার ভাবা যাক। বোর্ডটা দিন। এঁকে দেখিয়ে দিচ্ছি।
টেবিল থেকে বোর্ডে ক্লিপ দিয়ে লাগানো কাগজের প্যাডটা এনে দিল প্রেমাংশু। ডাক্তার পেনসিল দিয়ে ছুরির ফলা আঁকতে বসলেন। বক্রাকার ফলা। পেনসিলের রেখা শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে গেল কাগজের বাইরে।
হল না। বড় কাগজ দিন।
টেবিল থেকে বড় সাইজের একটা কাগজ নিয়ে এল প্রেমাংশু। ঘাড় বেঁকিয়ে নিবিষ্ট চোখে চেয়ে রইল ইন্দ্রনাথ।
ছুরির ফলা সাধারণত পাঁচ ইঞ্চি লম্বা হয়।
ডাক্তার তাই আরও দুই ইঞ্চি বাড়িয়ে দিলেন বক্রাকার শীর্ষদেশকে। কিন্তু বেগ পেলেন। হাতল আঁকতে গিয়ে। প্রতিবারেই মনে হল, বড় সাইজের একটা গজাল।
প্রেম বললে–হাতলটা বেমক্কা লম্বা নয় তো?
সেক্ষেত্রে চোটগুলো আরও গম্ভীর হত।
কিন্তু এরকম ছুরি হয় নাকি? আধখানা চাঁদের মতো ফলা–নিজেরই হাত কেটে যাবে যে।
ডাক্তারেরও ধৈর্যচ্যুতি ঘটল এবার–সত্যিই তাই। এরকম ছুরি হতেই পারে না।
সহসা নড়ে উঠল ইন্দ্রনাথের দীর্ঘ দেহ। পায়ে-পায়ে এসে দাঁড়াল ডাক্তারের পেছনে– কাগজটা দেবেন? দেখি চেষ্টা করে।
চশমার ফাঁক দিয়ে শিবনেত্র হয়ে ক্ষণেক তাকালেন ডাক্তার। কিন্তু দ্বিরুক্তি না করে ইন্দ্রনাথের প্রসারিত হাতে তুলে দিলেন পেনসিল স্কেচটা।
কল্পচক্ষে ফলাটা অনুমান করতে পেরেছিল ইন্দ্রনাথ। তাই হাত চলল দ্রুত।
প্রলম্বিত ফলার সঙ্গে সমকোণে একটা লাইন টানল এবং খসখস করে মোটা করে এঁকে দিল হাতলটা।
কাস্তে! অবরুদ্ধ উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠল প্রেমাংশু।
হৃষ্টচিত্তে ঘুরিয়ে, ফিরিয়ে স্কেচটা দেখতে-দেখতে আপন মনেই বলল ইন্দ্রনাথ–হ্যাঁ, কাস্তে। বাঁ হাতে চালাতে সুবিধে! থ্যাংক ইউ, ডাক্তার!
ত্রস্তে চশমা খুলে তীক্ষ্ণ চোখে ইন্দ্রনাথকে নিরীক্ষণ করলেন ডক্টর ডিকসিট!
.
ঠিক সেই সময়ে ফাঁড়িতে একটা খবর পৌঁছোল।
গতকাল রাত বারোটার সময়ে একটা ল্যান্ডরোভার গাড়িকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেছে অকুস্থল থেকে। পুলিশ ভ্যানের বাম্পারে ধাক্কা লেগেছিল নিশাচর গাড়িটার। আজ সকাল আটটার সময়ে আবার একই জায়গায় দেখা গেছে একই গাড়িকে। নাম্বার মনে ছিল পুলিশ ড্রাইভারের। খুনের তদন্তে যদি প্রয়োজন হয়, তাই ঘটনাটা নিবেদন করে গেল ফাঁড়িতে।
মর্গ থেকে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে ফাঁড়ি ফিরেই খবরটা শুনে লাফিয়ে উঠল প্রেম।
ইন্দ্র, যাবি নাকি?
ল্যান্ডরোভারের খোঁজে?
কাস্তের মালিকের খোঁজে। রাত বারোটার সময়ে চন্দনবনে যায় কে, দেখা দরকার বই কী! অপরাধীর সাইকোলজি তোর অজানা নয়। খুনের পর খুনি বারবার ঘুরে ফিরে আসে অকুস্থলে–
হাই তুলে তুড়ি মারতে মারতে বললে ইন্দ্রনাথ–তোর মতো অসুরের শরীর আমার নয়। আমার ক্ষিদে পাচ্ছে। আমার ঘুম পাচ্ছে। কাল রাত থেকে ধকল যাচ্ছে। তুই যা।
একা?
শালপ্রাংশু কলেবরের আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে ইন্দ্রনাথ বলল–কাস্তেকেও ভয় পাস?
রসিকতা পরে করিস। চ, আগে ভুড়ি ঠান্ডা করে আসি। কেসটা একটা শেপ নিতে যাচ্ছে দেখছিস না?
তা তো দেখছি-ই, গাড়ির দিকে পা বাড়িয়ে বলল ইন্দ্রনাথ। বারো ঘণ্টার মধ্যেই অনেক তথ্য আবিষ্কৃত হল। কেম্পেগৌডা টাউনে নিশীথ রাতের আততায়ীর রহস্য উদ্ধার করতে পেরেছিল কিশোর গোয়েন্দা ললিতমোহন। কোনও দুবৃত্তের ঠিকুজিও নিশ্চয় জেনেছিল। ধাঁধা রচনা করে সেই তত্ত্বই হয়তো লিখে রেখেছিস সে। তারপর গিয়েছিল তার সঙ্গে দেখা করতে। কে সে?
ল্যান্ডরোভারের মালিক।
স্টার্ট নিল পুলিশ জিপ। অন্যমনস্কভাবে বাসন্তী রঙের নয়ন-মনোহর বাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে বললে ইন্দ্রনাথকে জানে। কিন্তু মনটা খচখচ করছে অন্য কারণে।
কী কারণে?
তুই বলছিস সেক্স-মার্ডার। কিন্তু সেক্স-মার্ডারের পেছনে একটা উন্মত্ত জিঘাংসা থাকে, একটা এলোমেলো পৈশাচিকতা থাকে। কিন্তু, একটু থেমে ফের বলল ইন্দ্রনাথ–ছুরির কোপের প্যাটার্নগুলো অদ্ভুত। যেন ইচ্ছে করেই একটা মরা দেহকে কুপোনো হয়েছে বীভৎস রূপ দেওয়ার জন্যে। তার আগে পরিপাটি করে তার দিয়ে ফাঁস দেওয়া হয়েছে গলায়। সবার ওপরে একটা সত্য থেকে যাচ্ছে, কেম্পেগৌডা টাউনে একটা গোপন রহস্যে নাক গলিয়ে ফেলেছিল হতভাগ্য ললিতমোহন। প্রেম, এ কি শুধুই যৌন হত্যা?